রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী।Rabindranath Tagore Biography in Bengali


আরো পড়ুন--রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প

     ছুটি
কাবুলিওয়ালা
খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন
ইঁদুরের ভোজ











সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর , আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর ।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী- Rabindranath Tagore Biography in Bengali

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

Rabindranath Tagore ( 1861-1941 )



 কলকাতা পত্তনের কয়েকদিন পর জগন্নাথ কুশারি নামে এক ব্যক্তি বাংলাদেশের যশোর - খুলনার গ্রাম ত্যাগ করে গোবিন্দপুরে এসে বসবাস করতে শুরু করলেন । জগন্নাথ থাকতেন জেলেপাড়ায় , তাদের পূজাআর্চা করতেন । সেই সূত্রে সকলে তাকে ঠাকুরমশাই বলে ডাকত । জগন্নাথ কিছুদিন পর ইংরেজদের সাথে কারবার শুরু করলেন । ইংরেজরা ঠাকুর এমনভাবে উচ্চারণ করত মনে হত টেগোর । সেই থেকেই কয়েক বছরের মধ্যেই কুশারী পদবী মুছে গিয়ে চালু হল ঠাকুর আর ইংরাজিতে Tagore । এই বংশের নীলমণি ঠাকুর ইস্ট - ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি পেয়ে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন করে জমিদারি স্থাপন করেন এবং জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন । ঠাকুরবাড়ির খ্যাতি প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত ঘটে দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকে । বিদ্ধান বুদ্ধিমান ধনবান বলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সেই যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি । তাঁর ভোগ - বিলাসিতা - প্রাচুর্যের জন্য লোকে তাকে প্রিন্স বলে ডাকত । তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত । তিনি উপনিষদের সুমহান আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন । তাঁর স্ত্রী সারদাদেবী ছিলেন পনেরোটি সন্তানের জননী । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর চতুর্দশ সন্তান ।

তাঁর জন্ম হয় ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ ঠাকুর বাড়িতে । ঠাকুর বাড়ি ছিল সেই যুগে সাহিত্য , সংস্কৃতি , শিল্পকলা , সংগীতের পীঠস্থান । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ , মধ্যম সত্যেন্দ্রনাথ , পরবর্তী সন্তান হেমেন্দ্রনাথ , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সকলেই ছিলেন প্রতিভাবান । রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই চার দাদার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি । বিরাট বাড়ি , তেমনি বড় সংসার , বহু আত্মীয় পরিজন , দাস দাসী , পাইক বরকন্দাজ , ঐশ্বর্য - প্রাচুর্যের কোনো অভাব ছিল না ।



কিন্তু তা সত্ত্বেও শিশু রবীন্দ্রনাথের জীবন কেটেছিল নিতান্তই সরল সাদাসিধা ভাবে ঝি - চাকরদের হেফাজতে । একটু বড় হতেই রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে । অল্প কিছু দিন পর সেখান থেকে গিয়ে ভর্তি হলেন নর্ম্যাল স্কুলে । বাড়িতে ছেলেদের সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করবার জন্য দেবেন্দ্রনাথ বিচিত্র শিক্ষার আয়োজন করেছিলেন । ভোরবেলায় পালোয়ানের কাছে কুস্তি শেখা , তারপর গৃহ - শিক্ষকের কাছে বাংলা , অঙ্ক , ভূগোল , ইতিহাস পড়া । তারপর স্কুলে যাওয়া । স্কুল ছুটির পর ইংরাজী পড়া , ছবি আঁকা , জিমনাস্টিক । রবিবারের সকালটা বরাদ্দ থাকত বিজ্ঞান পড়ার জন্য । রুটিন বাঁধা জীবনে শিশু মন মাঝে মাঝে হাঁফিয়ে উঠত । 

এগারো বছর বয়সে প্রথম মুক্তির স্বাদ পেলেন রবীন্দ্রনাথ । সেই সময় ১৮৭৩ সালে পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গেলেন তিনি । বোলপুর তখন নিতান্তই এক গ্রাম । সেই প্রথম প্রকৃতির সাথে পরিচয় ঘটল তাঁর । এখানেই বালক কবির কাব্যরচনার সূত্রপাত হয়েছিল । বোলপুর থেকে গেলেন হিমালয় । চার মাস পশ্চিমের ভ্রমণ শেষ করে কলকাতায় ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ । স্কুলে যেতে তাঁর ভাল লাগে না । তাই বাড়িতেই শিক্ষক রাখা স্থির করা হল । চলতে লাগল পড়াশুনা আর কবিতা লেখা । তেরো বছর আট মাস বয়সে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রথম স্বনামে কবিতা ছাপা হল , “ হিন্দুমেলার উপহার ” ।

দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চা করেন । তাঁদের আড্ডায় এসে যোগ দেন অক্ষয় চৌধুরী , বিহারীলাল চক্রবর্তী , নবীনচন্দ্র সেন , —এঁদের সাথে কিশোর রবীন্দ্রনাথও যোগ দেন । ১২৮৪ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ' ভারতী ' পত্রিকা প্রকাশিত হল । সেখানে নিয়মিত লিখে চলেন রবীন্দ্রনাথ । বেশির ভাগ রচনা অপরিণত হলেও তার মধ্যেও কি তিভার চিহ্নটুকু খুঁজে অসুবিধা হয় না । বৈষ্ণব কবিতার ভাবনির্যাস শিশু বয়স থেকেই কবিকে আকৃষ্ট করত । ষোল বছর বয়সে লিখলেন ' ভানুসিংহের পদাবলী । ব্রজবুলি ভাষায় এই কবিতাগুলি লেখা । বৈষ্ণব পদাবলীকে অনুসরণ করলেও এর কাব্যরসকে অস্বীকার করা যায় না । ধীরে ধীরে কৈশোর বয়স উত্তীর্ণ হল রবীন্দ্রনাথ - এর । অভিভাবকদের সমস্ত রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও স্কুলের গন্ডী উত্তীর্ণ হতে পারলেন না তিনি । স্থির হল বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হবেন । মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সাথে বিলেতে রওনা হলেন । বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী পুত্র - কন্যাকে নিয়ে আগেই বিলাতে গিয়েছেন । লন্ডনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে পাবলিক স্কুলে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন । কিন্তু পড়াশুনায় মন না থাকায় বেশিরভাগ সময়ই কেটে যেত সাহিত্যচর্চা আর নাচ - গান করে । দেড় বছর বিলেতে থাকলেন । যে উদ্দেশ্যে বিলেত গিয়েছিলেন তার কিছুই হল না । দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে যখন দেশে ফিরে আসেন তখন তিনি উনিশ বছরের এক যুবক । বাড়িতে চলেছে নাটকের মহড়া । জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘ মানময়ী ’ নাটক মঞ্চস্থ করা হল । বাড়ির সব সদস্যই তাতে অংশগ্রহণ করলেন । কবির মন তখন নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে । এবার কবি লিখলেন গীতিনাট্য “ বাল্মীকি প্রতিভা ” —এটি কবি প্রতিভার প্রথম সার্থক প্রয়াস যা আজও সমানভাবে জনপ্রিয় । তরুণ কবির হাতে তখন ঝর্ণাধারার মত কবিতা রচিত হতে থাকে । প্রকাশিত হল ‘ ভগ্নহৃদয় ’ ও ‘ রুদ্রচন্ড ’ । এই কাব্য দুটিতে কবি প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ না ঘটলেও সেই সময় কাব্য দুটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল । রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বৌদি কাদম্বরী দেবী তখন থাকতেন চন্দননগরে ।

কবি তাঁদের কাছে গেলেন । বাড়ির পাশেই গঙ্গা । কবি লিখেছেন — সেই প্রথম আমি অনুভব করলাম বাংলাদেশের নদীই বাংলাদেশের প্রাণের বাণী বহন করে । পরবর্তী জীবনে নদী তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন “ বৌঠাকুরাণীর হাট ” । এটি তাঁর প্রথম উপন্যাস । প্রতাপাদিত্যের জীবন অবলম্বন করে এর কাহিনি গড়ে উঠেছে । ‘ বৌঠাকুরাণীর


হাট ' ধারাবাহিকভাবে ' ভারতী ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ( ১৮৮৩ ) । চন্দননগর থেকে জ্যোতিন্দ্রনাথ এসে বাসা বাঁধলেন সদর স্ট্রীটের বাড়িতে । এখানে কবির জীবনে ঘটল এক নতুন উপলব্ধি যে কথা কবি তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন— সূর্যোদয় হইতেছিল , বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেই দিকে চাহিলাম , হঠাৎ এক মুহুর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল । দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন । আমার হৃদয়ে যে বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাকে বিশ্বের আলোকে একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল । 


এই অপূর্ব অনুভূতির মধ্যে দিয়েই কবির অস্তস্থিত কাব্য সত্তার জন্ম হল । সেই দিনই কবি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ । ' ১৮৮৩ সালের ৯ ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হল । ঠাকুর বাড়িরই এক কর্মচারীর কন্যা । বারো বছর বয়স । বিয়ের আগে নাম ছিল ভবতারিণী । বিয়ের পর নতুন নাম হল মৃণালিনী ।  

বিবাহের পাঁচ মাসের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক অপ্রত্যাশিত আঘাত নেমে এল । জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলেন । তিনি যে শুধু রবীন্দ্রনাথকে স্নেহ করতেন তাই নয় , রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা । সমস্ত জীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য রচনায় বৌদির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন । 


ভারতের প্রথম আই . সি . এস . সত্যেন্দ্রনাথ তখন পশ্চিমে চাকরি করছেন । তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য কলকাতায় এলেন । ঠাকুর বাড়িতে তখন অনেকগুলি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে । তাদের জন্যে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘ বালক ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন । রবীন্দ্রনাথ হলেন এর নিয়মিত লেখক । এখানেই প্রকাশিত হল ‘ রাজর্ষি ' উপন্যাস । পরে এর কাহিনি অবলম্বন করেই রচনা করেন ‘ বিসর্জন ' নাটক । ঠাকুরবাড়ি যে শুধু বাংলার সংস্কৃতির জগতের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল তাই নয় , আর্থিক দিক থেকেও ছিল অন্যতম ধনী । পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে ছিল ঠাকুরবাড়ির বিস্তৃত জমিদারি ।

দেবেন্দ্রনাথ তখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন । বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ দার্শনিক মানুষ , সত্যেন্দ্রনাথ সরকারী চাকরী করতেন , অন্য ছেলেরা জমিদারি দেখাশুনা করার মত উপযুক্ত ছিলেন না । তাই সব ভার এসে পড়ল রবীন্দ্রনাথের ওপর । বাংলার গ্রামে গঞ্জে নদীপথে ঘুরতে ঘুরতে রবীন্দ্রনাথ যে বিপুল অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তা তাঁর সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । জমিদারির হিসেব - নিকেশ করা বা খাজনা আদায়ে তাঁর বিশেষ মন নেই । মন ভেসে চলে কল্পনার জগতে । নিয়মে বাঁধা জীবনকে কোনদিনই মানিয়ে নিতে পারতেন না রবীন্দ্রনাথ । তাঁর জীবন প্রকৃত অর্থেই ছিল প্রবহমান নদীর মত । তাই বারে বারে তার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে । তিনি পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনের আবাহন করেছেন । তাঁর জীবনে , সাহিত্যে , কাব্যে , নাটকে সর্বত্রই এই পরিবর্তনের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় । দীর্ঘ আশি বছরের কাব্য সাধনায় তাই কখনো পুনরাবৃত্তি ঘটেনি ।

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতাগুলি নিয়ে প্রকাশিত হল মানসী ( ১৮৯০ ) । এতে কবি প্রতিভার শুধু যে পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে তাই নয় , বাংলা কাব্য জগতেও এ এক নতুন সংযোজন । বন্ধু শ্রীশচন্দ্র ‘ হিতবাদী ' নামে নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন । রবীন্দ্রনাথ হলেন এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক । সেই সময় জমিদারির কাজে নিয়মিত রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহে যেতে হত । তখন তিনি সেখানকার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন । সেখানকার মানুষজনদের ছোট ছোট সুখ - দুঃখের আলোয় জন্ম নিতে থাকে একের পর এক ছোট গল্প — দেনা - পাওনা , গিন্নি , পোস্টমাস্টার , ব্যবধান , রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা , প্রতিটি গল্পই প্রকাশিত হয় ‘ হিতবাদী ' পত্রিকায় । কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই হিতবাদীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল । অন্যের পত্রিকায় লিখে কি আর আনন্দ পাওয়া যায় । তাই তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রেরা মিলে একটি পত্রিকা বার করল , ' সাধনা ' । রবীন্দ্রনাথের গল্পের জোয়ার বইতে শুরু হল । প্রথম গল্প হল খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন , তারপর সম্পত্তি সমর্পণ , কঙ্কাল , জীবিত ও মৃত , স্বর্ণমৃগ , জয়পরাজয় , দালিয়া । প্রতিটি গল্পই বিয়োগান্ত । জমিদারির কাজে রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । ফাল্গুন মাস , কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই হঠাৎ কবির মধ্যে জেগে উঠল বর্ষাধারার আবেগ । লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা , ‘ সোনার তরী ” , “ গানে গরজে মেঘ ঘন বরষা কূলে একা বসে আছি । নাহি ভরসা । ” এই কবিতা নিয়ে সমসাময়িককালে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল । আসলে এক শ্রেণীর মানুষ তাঁর খ্যাতি প্রতিভায় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল । কিন্তু কবির সৃজনীশক্তির পথে তারা কোনোরকম প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারে নি । রবীন্দ্রনাথের নিজের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা । ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন — ইংরেজ ও ভারতবাসী ’ , ‘ ইংরেজের আতঙ্ক ’ , ‘ সুবিচারের অধিকার ’ , ‘ রাজা ও প্রজা ’ । প্রতিটি রচনায় ফুটে উঠেছে তাঁর গভীর দেশাত্মবোধ । - ১৩০১ সালে প্রতিষ্ঠা হল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ । প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই এর সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাতে লোকসাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা হয় সেই ব্যাপারে তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ । প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম বাংলার লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি দেশের শিক্ষিত মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশের ছড়া সংগ্রহের কাজ শুরু হয় । এই সময় দক্ষিণারঞ্জন রচনা করলেন ‘ ঠাকুরমার ঝুলি ' । পরের বছর প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের ‘ চিত্রা ’ আর ‘ চৈতালি ’ । চিত্রায় কবি স্বপ্নলোক থেকে বাস্তব জীবনের পটভূমিতে নেমে এসেছেন । এতে সংকলিত কবিতাগুলি হল এবার ফিরাও মোরে , পূর্ণিমা , স্বর্গ হতে বিদায় , ঊর্বশী , ব্রাহ্মণ । এছাড়া তাঁর দুটি জনপ্রিয় কবিতা ‘ পুরাতন ভৃত্য ’ ও ‘ দুই বিঘা জমি’তে অবহেলিত নির্যাতিত মানুষের প্রতি সমবেদনা ফুটে উঠেছে । কবিতা ও গানের পাশাপাশি একের পর এক কাব্য নাটক লিখতে থাকেন । বহুদিন

আগে লিখেছিলেন প্রকৃতির পরিশোধ , চিত্রাঙ্গদা , বিদায় অভিশাপ , মালিনী । এবার লিখলেন গান্ধারীর আবেদন , সতী , নরকবাস , লক্ষ্মীর পরীক্ষা । দেশের অতীত ইতিহাস , তার গৌরবগাথা , মানুষের ত্যাগের মহিমা রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । তারই প্রকাশ ঘটেছে ‘ কথা ও কাহিনী’র কবিতাগুলির মধ্যে । রচনা ‘ চিরকুমার সভা ' । ‘ ভারতী ' পত্রিকা থেকে নতুন কিছু রচনা করার তাগিদ আসায় লিখলেন হাস্যরসাত্মক  নিজের রচনা করার ফাঁকে ফাঁকে অন্যদেরও রচনায় নানাভাবে সাহায্য করতেন । তিনি কোনদিনই আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন না । শুধু তরুণ সাহিত্যিকরা নয় , অনেক প্রবীণ লেখকেরাও তাঁর কাছে নিজেদের লেখা নিয়ে আসতেন । নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁদের লেখা পড়তেন , সংশোধন করে দিতেন , প্রয়োজনমত পরামর্শ দিতেন । নিজে সাহিত্য জগতের মানুষ হয়েও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল । ভারতে বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটানোর জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অপরিসীম । জগদীশচন্দ্ৰ বসু তখন বিলাতে গবেষণা করছেন , তাঁর অর্থের প্রয়োজন । রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের শরণাপন্ন হলেন । মহারাজা রবীন্দ্রনাথকে দশ হাজার টাকা দিলেন । ১৩০৮ সালে ( ইং , ১৯০১ সাল ) নতুন করে ‘ বঙ্গদর্শন ' প্রকাশিত হল । রবীন্দ্রনাথ তার সম্পাদক হলেন । প্রবন্ধ কবির কবিতার সাথে প্রকাশিত হল তাঁর নতুন উপন্যাস— ‘ চোখের বালি ’ । এর আগে কবির আর কোনো উপন্যাসেই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রকাশ ঘটেনি । শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ বহুদিন সপরিবারে থাকার পর শান্তিনিকেতনে এলেন । এখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন আবাসিক বিদ্যালয় । তাঁর ইচ্ছা ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের আশ্রমের আদর্শে এখানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি । স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় কলকাতায় নিয়ে আসা হল । অল্পদিনের মধ্যেই মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হল । তখন মৃণালিনী দেবীর বয়স ছিল ত্রিশ , আর রবীন্দ্রনাথের একচল্লিশ বছর । তাঁদের তিন কন্যা মাধুরীলতা , রেণুকা , মীরা , দুই পুত্র রথীন্দ্রনাথ আর সমীন্দ্র । মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই কন্যা রেণুকা অসুস্থ হয়ে পড়ল । কবির আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো গেল না । তখন রেণুকার বয়স মাত্র তেরো । অল্প কিছুদিন আগেই তার বিয়ে হয়েছে । পর পর দুটি বিরাট আঘাত পেলেও তাঁর সৃষ্টির পথ মুহূর্তের জন্যও স্তব্ধ হয়নি । এদিকে দেশের পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছিল । বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাদেশকে দ্বিখন্ডিত করতে সচেষ্ট হলেন । বহু মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলনের ফলে সে প্রচেষ্টা সফল না হলেও বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেল । রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন এদেশের মূল সমস্যা দারিদ্র্য , প্রয়োজন গ্রামীণ ক্ষেত্রে উন্নয়ন , পল্লী সংগঠন । তাঁর সেই অভিমত সেই সময় কোনো গুরুত্ব না পেলেও উত্তরকালে সকলেই তার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন । সে যুগে ধনী পরিবারের সকলেই পুত্রদের বিলাতে পাঠাতেন , আই . সি . এস . কিম্বা ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথকে ও বন্ধু পুত্র সম্ভোষচন্দ্রকে আমেরিকায় পাঠালেন কৃষি ও গো - পালন সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য , যাতে তারা গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারে । 

 

রবীন্দ্রনাথের এই প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল শ্রীনিকেতনে । কবির ভাবনা বিকশিত হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন আর শিলাইদহে । তার পাশাপাশি চলতে থাকে গীতাঞ্জলির গান লেখার কাজ । ' প্রবাসী ' পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে কবি লিখতে আরম্ভ করলেন তাঁর বিখ্যাত ' গোরা ' উপন্যাস । প্রায় তিন বছর ধরে ' গোরা ' প্রকাশিত হল ' প্রবাসী ' পত্রিকায় । ' গোরা ' রবীন্দ্রনাথের এক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি । হিন্দু সমাজ , জীবন , তার ধর্মীয় সংকীর্ণতা , জাতিভেদের ঊর্দ্ধে রবীন্দ্রনাথ এক সত্যের ইঙ্গিত করেছেন এই উপন্যাসে । নিত্যদিনের জীবন ধারার বাইরে কবির মন মাঝে মাঝে গভীর অনুভূতির আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত । শান্তিনিকেতনে বসে কবি লিখলেন ‘ ডাকঘর ' । শুধু বাংলা নয় , বিশ্বসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাটক এই ‘ ডাকঘর ' । বহুদিন দেশের বাইরে যাননি রবীন্দ্রনাথ । পুত্রবধূ প্রতিমাকে নিয়ে এবার বিলাতে গেলেন । প্রতিমা গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনায়নী দেবীর কন্যা । অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছিলেন । এক বাল্যবিধবার সাথে নিজের পুত্রের বিবাহ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার কোনো তুলনা হয় না । বিলেতে এসে কবির সাথে পরিচয় হল ইংরেজ কবি ইয়েট্স - এর । ইয়েটস্ রবীন্দ্রনাথের ‘ গীতাঞ্জলি ’ অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়ে এর ভূমিকা লিখলেন । ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হল গীতাঞ্জলি । ইংল্যান্ডের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে যথেষ্ট সাড়া পড়ে গেল । বিভিন্ন পত্র - পত্রিকায় এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বের হল । ১৯১৩ সালের ১৫ ই নভেম্বর কবি আমেরিকা ঘুরে শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন । ওইদিন সন্ধ্যাবেলা সংবাদ এল কবি সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন । তিনিই প্রথম প্রাচ্যবাসী যিনি এই পুরস্কার পেলেন । পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা । কলকাতা থেকে পাঁচশো মানুষ গিয়ে কবিকে শ্রদ্ধা জানালেন । অর্থ , যশ , খ্যাতি কবির জীবনকে কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি । এলাহাবাদে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন । হঠাৎ চোখে পড়ল পরলোকগতা বৌদি কাদম্বরী দেবীর একটি ছবি । লিখলেন নতুন কবিতা ‘ ' ছবি ' । তারপর একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকে ‘ বলাকার ’ অবিস্মরণীয় সব কবিতা । ' সবুজের অভিযান , ‘ শঙ্খ ’ , ‘ শাজাহান ’ , ‘ ঝড়ের খেয়া ’ , ‘ বলাকা ' । নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘ সবুজ পত্র । নতুন কোনো পত্রিকা চালু হলেই তাকে ভরিয়ে তোলার দায়িত্ব এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ওপর । রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই নারীকে অন্তঃপুরের বাসিন্দা হিসাবে দেখতে চাননি । তিনি নারীদের স্বতন্ত্র মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন । তারই প্রকাশ ঘটল ‘ সবুজ পত্রে ’ একের পর এক প্রকাশিত ছোটগল্পে । এইসব গল্পের মধ্যে বিখ্যাত হৈমন্তী , বোষ্টমী , স্ত্রীর পত্র । নারী সমাজের প্রতি তৎকালীন বাঙালী সমাজের মানসিকতার বিরূদ্ধে এ এক তীব্র আঘাত । ' স্ত্রীর পত্র ’ সেই সময় শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট ঝড় তুলেছিল । ১৩২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘ সবুজপত্রে ' লিখতে আরম্ভ করলেন “ ঘরে বাইরে ” । রবীন্দ্রনাথ মেকি বিপ্লবীয়ানাকে কোনোদিনই মেনে নিতে পারেন নি । তিনি বাস্তব পরিস্থিতিকে বিচার করেই সব কিছু বিবেচনা করতেন । তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন , লোকের মনকে অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষিত না করে অহিংস প্রতিরোধের আন্দোলন চলতে

পারে না — পদে পদে অনর্থের ও সমস্যার সৃষ্টি হবে । রবীন্দ্রনাথ যে কতখানি নির্ভুল ছিলেন পরবর্তীকালে তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে । ১৯১১ সালের ১৩ ই এপ্রিল ইংরেজ সৈন্যরা জালিয়ানওয়ালাবাগে ৩৭৯ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করল । এই ঘটনায় তীব্র ঘৃণায় রবীন্দ্রনাথের সমস্ত অন্তর ভরে উঠল । তিনি বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে লেখা এক খোলা চিঠিতে সরকার প্রদত্ত ' নাইটহুড ' উপাধি ত্যাগ করবার কথা ঘোষণা করলেন । ইংরেজ শাসকরা এতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হল । কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে অভিনন্দন জানাল । দেশাত্মবোধ তাঁর মধ্যে এতটাই প্রবল ছিল যে , প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ওটেন সাহেব যখন ছাত্রদের হাতে মার খেলেন , অনেকে ছাত্রদের নিন্দা করলেও তিনি তা করেননি । ছাত্র শাসন প্রবন্ধে লিখলেন , ছাত্ররা যদি প্রতিনিয়ত বিদেশী অধ্যাপকের কাছে তাদের দেশের , জাতির , ধর্মের অপমানকর কথা শোনে , ক্ষণে ক্ষণে তারা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করবেই , যদি না করে তবে সেটাই হবে লজ্জা আর দুঃখের বিষয় । অন্যদিকে আবার চৌরিচৌরার ঘটনার পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , —অহিংসা মন্ত্রকে য়োগ করার ক্ষেত্রে বিপদ অনেক লোকের মনকে প্রস্তুত এভাবে রাজনীতির মধ্যে না করে এরূপ আন্দোলনের প্রবর্তন আর রণশিক্ষা না দিয়ে যুদ্ধে সৈন্য নামানো একই । ইংরেজের বিরূদ্ধে ক্রোধকে উত্তেজিত করে তারপর অহিংসার মন্ত্র দ্বারা সে রিপুকে বশ মানানো যায় না । ক্রোধ তার ঈন্ধন খোঁজে । দেশের হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন — ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু - মুসলমান কেবল মিলিত হতে হবে তা নয় , সমকক্ষ হতে হবে ... এক্ষেত্রে শুধু চরকায় সুতো কাটলে সমস্যার সমাধান হবে না , বিদেশীকে বিদায় করলেও আগুন জ্বলবে ... এমনকি স্বদেশী রাজা হলেও দুঃখ দহনের নিবৃত্তি হবে না । রবীন্দ্রনাথের এই প্রকার দূরদর্শিতার নির্ভুলতার প্রমাণ পাওয়া যায় , স্বাধীনতার সুদীর্ঘকাল পরে সাম্প্রদায়িক হানাহানির মাধ্যমে । শুধুমাত্র ভারতেই নয় , যেখানেই মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে , মানবতা বিপন্ন হয়েছে , কবি সরবে তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন । যখন যে দেশে গেছেন সেখানে শান্তির বাণী প্রচার করেছেন । তাই ইউরোপ , আমেরিকার শ্রেষ্ঠ মানুষেরা সাদরে তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন । কবিকে তাঁরা দেখেছিলেন ভারত আত্মার মূর্ত প্রতীকরূপে । কবি যেই দেশে গেছেন তার যা কিছু শ্রেষ্ঠ সম্ভার তাঁকে গ্রহণ করেছেন । তারই প্রকাশ ঘটেছে কবিতায় , গানে , প্রবন্ধে , নাটকে । এই সমন্বয়ের আদর্শকে একত্রিত করে শান্তিনিকেতনকে গড়ে তুলেছিলেন প্রাচ্য - পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্রে । তখন কবি প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেছেন । পরিণতির সাথে সাথে রচনায় ফুটে ওঠে পরিবর্তনের ছোঁওয়া । এই সময় লিখলেন ' রক্তকরবী ’ , ‘ চন্ডালিকা ' । রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার মানুষদের কর্মপ্রচেষ্টা কবির ভাল লেগেছিল । নতুন দেশ গড়ার উদ্যম কবিকে মুগ্ধ করেছিল । তিনি লিখলেন ' রাশিয়ার চিঠি । বৃদ্ধ বয়সে এসে কবি সব সময়ই ডুবে থাকেন গান আর ছবি আঁকায় । আবার তারই ফাঁকে ফাঁকে লিখলেন শ্যামলী , প্রান্তিক , সেঁজুতি , আকাশ প্রদীপ , ছড়ার উৎসব , নৃত্যনাট্য শ্যামা । বয়সের ভারে দেহ নুয়ে পড়লেও লেখা আর বক্তৃতা বন্ধ হয়নি ।

 শান্তিনিকেতনের জন্য কবির ভাষায় ' ভিক্ষাপাত্র ' নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় । তাছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও ডাক আসে । কাউকেই ফেরাতে পারেন না । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বক্তৃতা দেবার জন্য কবিকে ডেকে পাঠানো হয় । তিনিই প্রথম বেসরকারী ব্যক্তি যিনি এই সম্মান পেলেন । বহুদিনের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে কবি বাংলায় বক্তৃতা দিলেন । পড়াশুনা , ছবি আঁকা , লেখা , সাহিত্য সভা — এসবের মধ্যেও সমসাময়িক ঘটনাবলীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না । কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য করা হল । রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় মর্মাহত হলেন । তিনি লিখলেন— কংগ্রেসের অন্তঃসঞ্চিত তাপ হয়তো তাঁর অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠেছে । শুধুমাত্র স্বদেশের মধ্যেকার মানুষদের বিবাদ - বিসংবাদ নয় , ইউরোপের বুকে জার্মানির আগ্রাসন , চীনের উপর জাপানের অত্যাচার কবিকে মর্মাহত করত । তিনি জাপানী কবি ইয়ান নোগুচিকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন — আমি জাপানিদের ভালবাসি কিন্তু তাদের জয় কামনা করতে পারি না । অনুশোচনার ভিতর দিয়ে তাদের প্রায়শ্চিত্ত হোক । ” ১৯৪০ সালের ৭ ই আগস্ট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে শান্তিনিকেতনে কবিকে ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হল । দেরীতে হলেও শেষপর্যন্ত ইংরেজরা কবিকে সম্মান জানাল । কবির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে । দেহ আর আগের মত সচল নেই । তবুও তারই মধ্যে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গল্প — ল্যাবরেটরি , বদনাম । বিছানায় শুয়ে শুয়ে কবি বলে যান আর অন্যেরা তা শুনে লিখে নেয় । এই সময়ে লেখা কবিতাগুলি সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হল — ‘ রোগশয্যায় । রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিম পর্বের প্রতিটি লেখার মধ্যে আধুনিকতা স্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হয় । জীবনের পরিণতির সাথে সাথে কবির মধ্যেও এক পরিবর্তন এসেছে । তিনি হয়ে উঠেছেন সংস্কার মুক্ত , উদার । কল্পনার জগত থেকে নেমে এসেছেন বাস্তবের রুক্ষ্ম মাটিতে । সেই কারণেই তাঁর প্রসঙ্গে জনৈক প্রবীণ সমালোচক লিখেছেন , — সাধারণত বয়সের সাথে সাথে লোকের রক্ষণশীলতা বাড়ে , কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় হয়েছে ঠিক তার উল্টো , যত বয়স বেড়েছে ততই তিনি মুক্ত হয়েছেন । চিকিৎসার জন্য কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল । জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির অপারেশন করা হল । তার কিছুক্ষণ আগে লিখেছেন জীবনের শেষ কবিতা ।


তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছে আকীর্ণ করে বিচিত্র ছলনা জালে হে ছলনাময়ী 

----------------------------------------

শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভান্ডারে অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার । অপারেশনের পর কবি জ্ঞান হারালেন । সে জ্ঞান আর ফিরল না । রাখী পূর্ণিমার একটি মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল । দিন দুপুর বেলায় ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ ( ইং ১৯৪১ সালের ৭ ই আগস্ট )


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ