Our neighborhood Durga Puja
দুর্গাপূজা: ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী—এক উৎসবের গল্প দুর্গাপূজা বাঙালি জীবনের অন্যতম প্রধান উৎসব। বছরের প্রতীক্ষিত পাঁচটি দিন—ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত—প্রতিটি বাঙালির মনে এক নতুন আনন্দের ঝলক এনে দেয়। দুর্গাপূজার প্রতিটি দিনই এক বিশেষ অনুভূতির প্রতীক, যা আমাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
ষষ্ঠী: মায়ের আগমনের প্রার্থনা ষষ্ঠীর দিন থেকে দুর্গাপূজার আচার-অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ষষ্ঠীর সকালে** ঘটে দেবী দুর্গার বোধন —যার অর্থ মায়ের ঘুম ভাঙানো, তাঁকে পৃথিবীতে স্বাগত জানানো। দেবী দুর্গার এই আগমন আমাদের মনে উচ্ছ্বাসের স্রোত বইয়ে দেয়।
ষষ্ঠীর দিনটি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে কলাবউ পূজার মাধ্যমে। একটি কলাগাছকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়, যাকে বলা হয় নবপত্রিকা। নবপত্রিকা দেবীর শক্তির প্রতীক, যা প্রকৃতি এবং সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর অঙ্গীকারের চিহ্ন।
সন্ধ্যাবেলায় মণ্ডপগুলোতে মায়ের মুখ উন্মোচন করা হয়, মায়ের অপরূপ প্রতিমা দর্শনে ভক্তদের হৃদয় ভরে ওঠে আনন্দে। মণ্ডপের প্রতিটি কোণ তখন ঢাকের বোল, শঙ্খধ্বনি এবং উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে মুখরিত হয়। সবাই নতুন পোশাকে সেজে উঠে মায়ের কাছে প্রার্থনা করে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সুখের জন্য।
সপ্তমী: পূজার মূল আচার শুরু সপ্তমীর দিন থেকে দুর্গাপূজার পূর্ণাঙ্গ পূজা অনুষ্ঠান শুরু হয়। ভোরবেলা নবপত্রিকাকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে মায়ের পায়ে নিবেদন করা হয়। এই নবপত্রিকা দেবীর নয়টি রূপের প্রতীক, যা প্রাকৃতিক শক্তির সাথে দেবীর সংযোগকে প্রতিফলিত করে।
সপ্তমীর পূজা অনেকটাই ঐতিহ্যবাহী। দেবীর আরাধনা শুরু হয় নির্দিষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ ও অর্ঘ্য প্রদানের মাধ্যমে। ভক্তরা মায়ের পায়ে ফুল, ফল, ধূপ এবং প্রদীপ নিবেদন করে। সপ্তমীর দিন মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তদের ঢল নামে। পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে মণ্ডপে এসে পূজা দেখে এবং পূজার প্রসাদ গ্রহণ করে।
দেবী দুর্গার স্নিগ্ধ মুখমণ্ডলে সবাই যেন শক্তি ও শান্তির সন্ধান পায়। সপ্তমীর দিনে মণ্ডপগুলো আলোয় ভরে ওঠে, এবং পূজার পরিবেশ আরও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ঢাকের তালে তালে কিশোর-কিশোরীরা নাচে মেতে ওঠে, যেন আনন্দে ভরিয়ে দেয় আশেপাশের পরিবেশ।
মহাষ্টমী: দেবীর বীরত্বের পূজা মহাষ্টমী হলো দুর্গাপূজার সবচেয়ে পবিত্র দিনগুলোর মধ্যে একটি। এই দিনে দেবীর বিশেষ পূজা এবং কুমারী পূজা হয়। কুমারী পূজা হলো বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম আধ্যাত্মিক আচার, যেখানে একটি কন্যা শিশুকে দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। এটি নারীর শক্তি এবং পবিত্রতার প্রতীক।
অষ্টমীর সন্ধ্যায় হয় সন্ধিপুজো যেখানে দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপের বন্দনা করা হয়। এই সময়ে মন্দির এবং মণ্ডপে শঙ্খ, ঢাক আর উলুধ্বনির মন্ত্রমুগ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সন্ধিপুজোর প্রতিটি মন্ত্র আর ঘন্টার ধ্বনিতে ভক্তদের মধ্যে দেবীর শক্তি অনুভব করার এক গভীর অনুভূতি তৈরি হয়।
মহানবমী: আনন্দের চরম মুহূর্ত
নবমীর দিন দুর্গাপূজার আরেকটি মহিমান্বিত দিন। এই দিনে মাকে সমৃদ্ধ ভোগ নিবেদন করা হয়, এবং বিশেষ অঞ্জলি দিয়ে তাঁকে আরাধনা করা হয়। নবমীর দিন মণ্ডপের চারপাশে ভক্তরা আনন্দে মেতে ওঠে। সবাই নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে মায়ের পায়ে অর্ঘ্য দেয় এবং তাঁর আশীর্বাদ কামনা করে।
মহানবমীর রাতে হয় দেবীর সর্বশেষ পূজা। ভক্তদের মনে তখন আনন্দ আর বিষাদের এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করে, কারণ পরের দিনই মা বিদায় নেবেন। মায়ের পূজার আয়োজন শেষ হলেও, ভক্তদের মনে তখন মাকে আবার এক বছর পর দেখার আশায় বুক বাঁধা থাকে।
বিজয়া দশমী: বিদায়ের বিষাদের মাঝে মিলনের আনন্দ বিজয়া দশমী হলো মাকে বিদায় জানানোর দিন। দশমীর সকালে মাকে বিসর্জন দেওয়ার আয়োজন শুরু হয়। তার আগে মায়ের পূজা করে প্রণাম জানানো হয়। বাঙালি নারীরা মণ্ডপে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে, একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করে। সিঁদুর খেলার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, তেমনই মাকে বিদায় জানানোর বেদনাও লুকিয়ে থাকে।
দেবী দুর্গাকে যখন গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়, তখন ভক্তদের চোখে জল আসে। আসছে বছর আবার হবে .এই মন্ত্র উচ্চারণ করে ভক্তরা মাকে বিদায় জানায়, যেন তিনি পরের বছর আবার ফিরে আসবেন। ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খধ্বনি, আর উলুধ্বনি গঙ্গার জলে প্রতিধ্বনিত হয়, যেন মায়ের শক্তি আমাদের মধ্যে চিরকাল জীবন্ত থাকে।
দুর্গাপূজার ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী—প্রতিটি দিনই বাঙালির জীবনে এক নতুন অনুভূতি ও উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে। ষষ্ঠী ও সপ্তমী দিয়ে শুরু হয়ে মহাষ্টমী ও নবমীতে পূজার পরাকাষ্ঠা দেখা যায়, এবং বিজয়া দশমীতে সেই পূর্ণতা পায় বিদায়ের বেদনা ও আশার মিশ্রণে। এই উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির মন, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের গভীর এক উৎসব, যা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
0 মন্তব্যসমূহ