এ.পি.জে . আবদুল কালাম জীবনী, A. P .j. Biography of Abdul Kalam
এ . পি . জে . আবদুল কালাম অবশেষে শেষ হয়ে গেল এক বর্ণময় চরিত্রের পথচলা । ১৯৩১ সালের তৎকালীন মাদ্রাজ বর্তমান তামিলনাড়ুর দ্বীপ শহর রামেশ্বরমের এক মধ্যবিত্ত তামিল পরিবারে জন্ম নেওয়া আবদুল পাকির জাইনুল আবেদিন আবদুল কালামের জীবন দীপ নিভে গেল ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই । শিলং - এ IINA- র একটি অনুষ্ঠানে ভাষণরত অবস্থায় আর এইভাবেই বোধহয় পরিসমাপ্তি ঘটল এমন এক কার্যর জীবনকথার যার প্রতিটি পরতে পরতে পলে অনুপলে আছে ঘাত - প্রতিঘাতের নানা উত্থান - পতনের কাহিনী ।
বাবা জাইনুল আবেদিন ,
মা আশিয়াম্মা । প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে ডঃ কালাম ভারেতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও প্রতিরক্ষা উন্নয়ন পরিচালনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ।
অবদানের- প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানী এবং ক্ষেপণাস্ত্র বিশারদ হিসাবে তাঁর খ্যাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল । অগ্নি , পৃথ্বী , আকাশ , ত্রিশূল , নীগাজ ইত্যাদি ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে তাঁর অবদানের কথা এবং কৃতিত্বের কথা আমরা সকলেই জানি ।
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং বিজ্ঞান চর্চায় তাঁর অবদানের কথা আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না , তাই তাঁকে আমরা একজন নেহাতই পরমাণু বিজ্ঞানী হিসাবে চিহ্নিত করব না , তিনি ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে কাজ করেছেন । এই সময়ও আমরা তাঁকে এক বলিষ্ট ভূমিকা নিতে দেখেছি । আসলে কালাম ছিলেন যে চরিত্রের মানুষ সেখানে কর্তব্য নিষ্ঠা , ন্যায়পরায়ণতা , নৈতিকতা , স্বদেশ প্রেম প্রভৃতি শব্দগুলি খাপ খেয়ে যায় । মানুষ হিসাবে সর্বদা মাটির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন । তাই বিখ্যাত বিজ্ঞানী কিংবা রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও বারবার প্রোটোকলের বাধানিষেধ ভেঙে দিয়েছেন । হাত মিলিয়েছেন ' আপামর জনসাধারণ - এর সঙ্গে । সেই জন্যই বোধহয় তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারত জুড়ে এমন শোকস্তব্ধ বিহ্বলতা দেখা দিয়েছে ।
দিল্লিতে যখন তাঁর মৃতদেহ রাজাজীমার্গের ঔপনিবেশিক স্থাপত্যে মোড়া বাড়িটিতে রাখা হয়েছিল তখন তাঁকে দেখতে অসংখ্য মানুষ সেখানে ভিড় করেছিলেন । শায়িত ছিলেন তিনি নীচের তলার বৈঠকখানা ঘরে । একদা এই ঘরে বসেই কত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন । আর তখন তিন বাই সাড়ে ছ'ফুট ডিভানে শোয়ানো তাঁর মৃতদেহ । তেরঙ্গা পতাকায় মোড়া মুখ ঢাকা আছে স্বচ্ছ পলিথিনে । ভোর থেকে অসংখ্য মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন । ভারতের মিশাইলম্যান - এর উদ্দেশ্যে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সেই লাইনে কে না ছিলেন ? বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ।
আমজনতা থেকে গৃহবধু , চোখে নতুন ভারতের স্বপ্ন আঁকা তরুণ তরুণীর দল । একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল তাঁর শেষ কৃত্যের সময় ।
রামেশ্বরমের দ্বীপ শহরের যেখানে তিনি পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন সেখানকার সাগর সৈকতেই তাঁর মৃতদেহ সমাহিত হল । পূর্ণ মর্যাদা সহকারে । ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সেখানে
উপস্থিত হয়েছিলেন । সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো । এইভাবে কালাম প্রমাণ করলেন যে , তিনি সত্যি পিপলস্ প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ জনগণের রাষ্ট্রপতি ।
কালামের জীবনের উত্থান কাহিনি শুনলে আমাদের অবাক হতে হয় বৈকি । একেবারে ছোটোবেলা থেকে তাঁকে নিরন্তর দারিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে । প্রথম জীবনে সংবাদপত্র সরবরাহ করে জীবীকা অর্জনের চেষ্টা করেছেন । এর পাশাপাশি চলেছে বিদ্যাশিক্ষা । লেখাপড়ার প্রতি অসীম আকর্ষণ বোধ করতেন কালাম ।
পড়াশোনার প্রতি আকর্ষণ তাঁকে রামেশ্বরমের দ্বীপ শহর থেকে ত্রিচিতে নিয়ে আসে । তারপর চেন্নাই হয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে চলে যাওয়া , ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় আধিকারিক হিসাবে যোগদান এসব শুনলে মন হবে তাঁর জীবন বুঝি স্বপ্নের এক দুরন্ত উড়ান । কিন্তু এই উড়ানের ফাঁকে ফাঁকে এমন কিছু প্রতিবন্ধকতা এবং ভয়াবহতা লুকিয়ে ছিল যে , তাঁকে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে সে জন্য । তার এই অবিশ্বাস্য উত্থানকে কেউ কেউ হিংসা করেছেন ।
অনেকেই তাঁর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করেছে , তবু কালাম হাসিমুখে সকলের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন । এমন অজাতশত্রু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় এমন সম্ভাবনা বর্তমান পৃথিবীতে খুব একটা নেই ।
তাই বোধহয় কালাম সত্যিকারের জনগণমন অধিনায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন । বিজ্ঞানী হিসাবে কালামের সার্থকতা কোথায় ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় তিনি কিন্তু বিজ্ঞানকে শুধুমাত্র গবেষণার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখেন নি । তিনি বারবার বিভিন্ন অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় ভাষণ প্রসঙ্গে বলেছেন , বিজ্ঞান যেন সারাজীবন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে তবেই বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রী তার ইন্সিত সাফল্য লাভ করবে ।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান চেতনা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে । বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিজ্ঞানের নানা কৃৎ কুশলতাকে কাজে লাগাতেন । এইভাবে তারা সাধারণ মানুষ থেকে বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন । এর নেতিবাচক ফল ফলতে বাধ্য । তাই কালাম এবং তাঁর সহযোগীরা চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের ছায়া যেন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে ।
বিজ্ঞান বাতায়ন পথে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করে সকলের মন যদি কুসংস্কার মুক্ত না হয় , তাহলে মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হবে কী করে ? কালামের স্বদেশ প্রেম ছিল দেখবার মতো । তিনি সর্বদা এক উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখতেন । যে , ভারত বিশ্বের অন্য সব দেশের কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে পারে অথচ সেই ভারত কখনও কারো ওপর রাজনৈতিক সামরিক , অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করবে না । তিনি ভারতকে সামরিক বলে বলীয়ান করতে চেয়েছিলেন , অবশ্য একটি উদ্দেশ্যে । তা হল ভারত যেন পাশ্চাত্যের শক্তিশালী দেশগুলির সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে । তা না হলে ভারতীয় হিসাবে আমাদের মনে একধরনের হীনমন্যতার জন্ম হবে । কালাম বলতেন , সেই দেশ বা সেই রাষ্ট্রকে সকলে শ্রদ্ধা করে যে দেশ বা জাতি যথেষ্ট শক্তিশালী । এটাই বোধহয় তাঁর জীবনকথা । কালামের অতি সহজ সরল সাধারণ জীবনযাপন সম্পর্কে নানা গল্পকথা প্রচলিত আছে । খোলামেলা চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি । পার্থিব বিষয় সম্পর্কে উদাসীন , অথচ লৌকিক জগতের উজ্জ্বল বাসিন্দা । নানাভাবে অনেক সময় তাঁকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে , এই তালিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আধিকারিকরা ছিলেন । কালাম কিন্তু কোথাও নিজেকে সুসজ্জিত করেননি মূল্যবান পোশাকে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও তিনি বারবার সাধারণ পোশাক পরে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গেছেন । বল্যাক ক্যাটসের সমস্ত সঙ্কেত এবং নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হয়ে উঠেছেন আমাদের মনের মানুষ । কালামের জীবনকথা পড়লে প্রতি মুহূর্তে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি ।
কালামের সীমাহীন জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল । তখন তিনি আর রাষ্ট্রপতি পদে আসীন নন , প্রাক্তন তকমাটি তাঁর নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবথেকে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক ।
এক্ষেত্রে কালাম অন্যান্য রাষ্ট্রপতির থেকে অনেক কদম এগিয়ে ছিলেন । একাধিক ক্ষেপনাস্ত্র অভিযানে তাঁকে নানা বাধার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে । চোখের সামনে দেখতে হয়েছে স্বপ্ন উড়ানের পতন এবং মৃত্যু । আর এইসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকরা মুখর হয়েছেন । তীব্র ভাষায় কালাম এবং তাঁর সহযোগীদের নিন্দা করেছেন । ভারতের মতো এক দরিদ্র দেশের পক্ষে এগুলি করা উচিত নয় । কার্টুনিস্টদের ছবিতে কালামকে নানাভাবে পরিস্ফুটিত করা হয়েছে । অন্য কেউ হলে হয়তো এইসব আক্রমণের সামনে ভেঙে পড়তেন , কিন্তু কালাম ভেঙে পড়েননি ।
তিনি লৌহ কঠিন মনোভাবের মানুষ ছিলেন । কালাম যদি শক্ত হাতে হাল না ধরতেন তাহলে ভারত আজ আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এভাবে এগিয়ে যেত না । আজ ভারত সামরিক শক্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী ।
তাই প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে সমীহ আদায় করতে পেরেছে । যখন ভারত বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে , তখন তাকে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে । এতো আমরা সহজেই বুঝতে পারছি ।
কালাম কিন্তু মনেপ্রাণে এটাই চেয়েছিলেন যে কোনো বৈজ্ঞানিক শক্তিকে সমাজের দীন দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে । এটাই ছিল তার জীবনের মর্মকথা । আর এই স্বপ্নকে সফল করার জন্য কালাম প্রাণপাত করে পরিশ্রম করেছেন ।
কালাম বলেছেন আমরা রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখব না । আমরা স্বপ্ন দেখব যা আমাদের সারা রাত জাগিয়ে রাখবে । তার মানে ? তার মানে আমরা আমাদের জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করব । সেই লক্ষে পৌঁছাতে হলে অনেক পরিশ্রম দরকার ।
প্রতি মুহূর্তে আমরা নিজেকে উৎসর্গ করব । আর এইভাবেই দেখতে দেখতে যখন ফুরিয়ে যাবে সেই পথ , আমরা অবাক হয়ে দেখব যে সফলতার সোনালী শিখর প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেছি । কালাম এমন এক মৃত্যুকে আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন , যে মৃত্যুতে দীর্ঘ রোগ ভোগের যন্ত্রণা থাকবে না । তিনি বলেছেন হাসতে হাসতে কাজ করতে করতে যে মানুষ মৃত্যুর ঠিকানা খুঁজে নেয় , সেই হল সব থেকে সৌভাগ্যবান ।
আরো পড়ুন-- সিস্টার নিবেদিতার জীবনী
আমরা জানি তিনি কীভাবে ভাষণ দিতে দিতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন । মঞ্চ থেকে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় । অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । কিন্তু ঘুম আর ভাঙেনি কালামের । আজ আবদুল কালাম আর আমাদের মধ্যে নেই । কিন্তু যতদিন বিশ্ব সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে , ভারতবর্ষ থাকবে , ততদিন আমরা তাঁকে ভুলতে পারব না । আগামী দিনে যে কোনো লড়াকু মানুষই তাঁর দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে । কালামের রামেশ্বরম থেকে নতুন দিল্লি এক দীর্ঘ যাত্রাপথ । এ যাত্রাপথে কত মানুষের সাথে তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে , কত জনকে তিনি আত্মার আত্মীয় করে নিয়েছেন । এভাবেই তো কালাম পথ চলেছেন । যে পথের দুপাশে কখনও হাজার ফুলের সুগন্ধিত সমাবেশ , আবার কখনও কিছু কাঁটার যন্ত্রণা । আবদুল কালাম বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে হয়তো এক অপরিচিত ব্যক্তিত্ব । কিন্তু বিজ্ঞান এবং সামরিক শক্তির জগতে তিনি এক অদ্বিতীয় পুরুষ একথা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই । সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এক এক ক্ষেপনাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপনের দ্বারা বিশ্বসভায় ভারতের মানোন্নয়ন করেছেন । ভারত আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । পৃথিবীর সামরিক শক্তির আকাশের অন্তরালে কালামের অবদান আমরা ভুলব কেমন করে । স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত এই মহান মানুষটি স্বদেশ প্রেমের আগুন শিখা জ্বালিয়ে রাখতেন তাঁর বুকের মধ্যে । তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতবাসী হিসাবে আমাদের উচিত গর্ববোধ করা । কারণ আমাদের আছে দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার এবং আমাদের সামনে পড়ে আছে সীমাহীন অন্বেষণের জগৎ । এই দুয়ের সংমিশ্রণে ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখল করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই ।
0 মন্তব্যসমূহ