ভগিনী নিবেদিতার জীবনী ও তার অবদান | Sister Nivedita Biography in Bengal

 নিবেদিতা Nivedita [ 1867-1911

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লোকমাতাবলেছিলেন

শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন শিখাময়ী । সুদূর আয়ারল্যান্ডের কন্যা মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে ভারতবর্ষে এসেছিলেন । ভারতের মাটিতে এসে তিনি হলেন নিবেদিতা ।


জন্ম পরিচয়---

উত্তর আয়ারল্যান্ডের ড্যানগ্যানন শহরে ধর্মযাজকের কাজ করতেন বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবল । তাঁর মায়ের নাম মেরী ইজাবেলা । দুজনেই ছিলেন সৎ ‘ ধার্মিক ' পরোপকারী । তাঁদের প্রথম সন্তান মার্গারেটের জন্ম হয় ১৮৬৭ সালের ২৮ শে অক্টোবর । স্যামুয়েল ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ । তিনি শহরের সুখী জীবন ছেড়ে গেলেন ইংল্যান্ডের ‘ম্যানচেস্টারের কয়লাখনি অঞ্চলে ।

সেখানকার গরীব মজুরদের মধ্যে ধর্মযাজকের কাজ করতে আরম্ভ করলেন । 

শিশু মার্গারেটকে তাঁর ঠাকুমার কাছে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল । তিনি প্রায় চার বছর সেখানে ছিলেন ।

মুক্ত প্রকৃতির নির্জনতার মধ্যে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে মার্গারেট । ততদিনে ম্যানঞ্চেস্টারে স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন স্যামুয়েল । মার্গারেটকে এবার তাঁরা তাঁদের কাছে নিয়ে গেলেন । ইতিমধ্যে মার্গারেটের একটি বোন হয়েছে ।

ম্যানেচস্টারের ঘিঞ্জি পরিবেশ ভাল লাগল না মার্গারেটের ।

কিছুদিন পর স্যামুয়েল কয়লাখনি অঞ্চল ছেড়ে চলে এলেন ছোট্ট গ্রাম টরেন্টনে । গ্রামের মুক্ত পরিবেশে আনন্দে মন ভরে ওঠে মার্গারেটের । ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধীর , শাঁত্ত , ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী । হঠাৎ মারা গেলেন স্যামুয়েল । নিতান্ত নিরুপায় হয়ে দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন মেরী । এখানে এসে মার্গারেট স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হলেন । স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কলিন্স মার্গারেটের ব্যক্তিত্বে , তাঁর অসাধারণ মেধায় অল্পদিনেই মুগ্ধ হলেন ।


আরো পড়ুন--ইন্দিরা গান্ধীর জীবন


ম্যানেচস্টারের ঘিঞ্জি পরিবেশ ভাল লাগল না মার্গারেটের ।

কিছুদিন পর স্যামুয়েল কয়লাখনি অঞ্চল ছেড়ে চলে এলেন ছোট্ট গ্রাম টরেন্টনে । গ্রামের মুক্ত পরিবেশে আনন্দে মন ভরে ওঠে মার্গারেটের । ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধীর , শাঁত্ত , ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী । হঠাৎ মারা গেলেন স্যামুয়েল । নিতান্ত নিরুপায় হয়ে দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন মেরী । এখানে এসে মার্গারেট স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হলেন । স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কলিন্স মার্গারেটের ব্যক্তিত্বে , তাঁর অসাধারণ মেধায় অল্পদিনেই মুগ্ধ হলেন ।

নিজের সমস্ত স্নেহ , ভালবাসা , জ্ঞান উজাড় করে দিলেন মার্গারেটকে । আর্থিক প্রয়োজনে মেরী বেলফাস্টে গিয়ে বোডিং খুললেন । মামার বাড়িতেই রয়ে গেলেন মার্গারেট । দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে যায় । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মায়ের কাছে গেলেন মার্গারেট । ছোটবেলা থেকেই মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার কথা ভাবতেন মার্গারেট । ডাক পেলেন রাগবির অনাথ আশ্রম থেকে । মা - বাপ হারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সেবার কাজ শুরু করলেন মার্গারেট । সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হল সৎ - উদার হৃদয় এক তরুণের । ভালবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়লেন দুজনে । অল্পদিনের মধ্যেই বিবাহ হয়ে গেল দুজনের ।

কিন্তু পার্থিব  জীবনের সুখভোগ , সে তো মার্গারেটের বিধিলিপি নয় ঈশ্বর যে তাঁকে দিয়ে আরো মহৎ কাজ করাবেন । হঠাৎই অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন তরুণ । বেদনায় ভেঙে পড়লেন মার্গারেট । চাকরি ছেড়ে দিয়ে গেলেন লিভারপুলে , সেখানে মা , ভাই , বোন সকলে একসাথে মিলিত হলেন । মন শান্ত হওয়ার পরে শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনা করছিলেন কয়েকজন শিক্ষাবিদ । তাঁদের রচনা পড়ে মার্গারেট এই ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন । মিসেস ডি লিউ নামে একজন ভদ্রমহিলা নতুন স্কুল খুললেন লন্ডনে । তাঁর সাথে মার্গারেট আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন । তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন স্কুলে যোগ দিলেন মার্গারেট ।

প্রচলিত শিক্ষার বাইরে তিনি শিশুদের নতুন ধরনের শিক্ষা দিতেন । শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিত সাহিত্যচর্চাও করতে থাকেন মার্গারেট । তাঁর রচনা বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে ছাপা হতে থাকে । অল্প দিনের মধ্যেই লেখিকা হিসাবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে । শিক্ষিকা আর লেখিকার শাক্ত জীবন মার্গারেটের জন্য ছিল না । স্বদেশভূমি পরাধীন আয়ারল্যান্ডের জন্য তাঁর সমস্ত অন্তর ব্যাকুল হয়ে ওঠে । লন্ডনে গড়ে উঠেছিল আইরিশ বিপ্লবের দুটি গোপন কেন্দ্র । মার্গারেট সেখানে যোগ দিলেন । কিন্তু কোনো কিছুতেই তৃপ্তি অনুভব করতে পারতেন না । মাঝে মাঝে মনে হত জীবনের প্রকৃত সত্য কি ? তাঁর অনুসন্ধিৎসু হৃদয় এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পেত না । ঠিক সেই সময় ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগো ধর্মসভায় হিন্দু ধর্মের বিজয় পতাকা উড্ডীন করে আমেরিকা থেকে এলেন ইংল্যান্ডে । স্বামীজি লন্ডনে এসে মিঃ স্টার্ডির গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করলেন । এখান থেকেই তাঁর বেদান্তের প্রচার শুরু করলেন । তাঁর বক্তৃতা শোনবার জন্য জ্ঞানী গুণী মানুষের ভিড় হতে লাগল ।


১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসের কোন একটি দিন । এবেনজার কুকু নামে একজন শিক্ষক মার্গারেটকে বললেন , ভারতবর্ষ থেকে একজন সন্ন্যাসী এসেছেন , আমরা তাঁর বক্তৃতা শুনতে যাব । তুমি যাবে আমাদের সাথে ? মার্গারেটের মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় একজন বৃদ্ধ ধর্মযাজক তাঁকে বলেছিলেন , —একদিন ভারতবর্ষ থেকে তোমার ডাক আসবে । তবে কি সেই ডাক এসেছে ? তবুও তেমন কোন আগ্রহ অনুভব করলেন না তিনি । ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তেমন কোন ধারণাই ছিল না তাঁর । নিতান্ত কৌতুহল বশতই একদিন তিনি বক্তৃতা শুনতে গেলেন । মার্গারেট ঘরে ঢুকতেই দেখলেন একটা আসনে ধ্যানগম্ভীর স্থির হয়ে বসে আছেন স্বামীজী । এক অপূর্ব সুষমা ফুটে উঠেছে তাঁর সমস্ত মুখমন্ডলে । কিছুক্ষণের মধ্যেই বক্তৃতা শুরু করলেন স্বামীজি । কি মধুর কণ্ঠস্বর । গভীর প্রজ্ঞা , জ্ঞান , আর ভালবাসা থেকে উৎসারিত হচ্ছিল তাঁর প্রতিটি শব্দ । মার্গারেটের মনে হল এ যেন তাঁর কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা । মার্গারেট স্বামীজীকে দেখে প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হলেও স্বামীজির চিন্তাভাবনা ও তাঁর যুক্তির কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেননি ।



কিন্তু এক অদৃশ্য আকর্ষণে তিনি বার বার৫৮৭ স্বামীজীর কাছে ছুটে যেতেন । যেখানেই স্বামীজী বক্তৃতা দিতেন সেখানেই সকলের আগে গিয়ে বসতেন মার্গারেট । কয়েকদিন পরেই স্বামীজী আমেরিকায় ফিরে গেলেন । কিন্তু মার্গারেটের হৃদয়ে জ্বলে উঠল এক নতুন আলো । স্বামীজীর মত এত গভীর আত্মপ্রত্যয়ে ধর্মের কথা তিনি এর আগে কোথাও শোনেননি । মার্গারেটের মনে হল হয়ত ঐ ভারতীয় সন্ন্যাসীর মধ্যে তিনি খুঁজে পাবেন তাঁর সকল জিজ্ঞাসার উত্তর । স্বামীজির চিন্তা ভাবনা , উপদেশকে আরো গভীরভাবে জানবার জন্য মার্গারেট শুরু করলেন ভারতীয় দর্শন , ধর্ম , সংস্কৃতির উপর গভীর অধ্যয়ন । পড়লেন বেদ , উপনিষদ , গীতা , রামায়ণ , মহাভারত । ১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে স্বামীজী আবার লন্ডনে এলেন ।

সেখানে তাঁর অনুগামীরা বক্তৃতার আয়োজন করলেন । ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন স্বামীজি । প্রতিদিন মার্গারেট আসেন , তাঁর প্রতিটি কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন । যখনই কোনো জিজ্ঞাসা বা সন্দেহ মনের মধ্যে জেগে ওঠে , বিনা দ্বিধায় প্রশ্ন করেন , অনেকে বিরক্ত হন । কিন্তু মার্গারেট বলেন , আমার অন্তর যা সায় দেয় না , আমি তা মেনে নিতে পারি না । স্বামীজি খুশি হয়ে মার্গারেটের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন । তিনি বলেন , বিচার না করে কারোরই কোন কিছুই গ্রহণ করা উচিত নয় । মার্গারেট মনের সকল জিজ্ঞাসা তুলে ধরেন স্বামীজির কাছে । প্রতিটি প্রশ্নের সহজ করে উত্তর দেন স্বামীজি । মার্গারেট বুঝতে পারেন এই সেই মানুষ এতদিন অন্তরে যার ডাক শুনেছেন । জের মনের কথা সকল দ্বিধা সংকোচের উর্দ্ধে উঠে মার্গারেট নিজের মনের কথা স্বামীজীকে বলেন । স্বামীজিও অনুভব করেছিলেন মার্গারেটের মধ্যেকার সুপ্ত শক্তি । তিনি একটি চিঠিতে লিখলেন ( ৭ ই জুন , ১৮৯৬ ) – তোমার মধ্যে জগৎ আলোড়নকারী শক্তি প্রচ্ছন্ন আছে । আমাদের এখন প্রয়োজন সাহসী বক্তার চেয়ে সাহসী কর্মীর । হে মহাপ্রাণ ওঠো জাগো জগৎ যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে তোমার কি নিদ্রা সাজে ! স্বামীজি বললেন , —ভারতীয় নারীদের কল্যাণের জন্য আমি কিছু কাজ করতে চাই । তুমি কি আমার সঙ্গী হবে ? স্বামীজির আহ্বানে সানন্দে সম্মতি জানালেন মার্গারেট । ইংল্যান্ড ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন স্বামীজি । মার্গারেটের ইচ্ছা ছিল স্বামীজির সঙ্গী হবেন । কিন্তু স্বামীজি বললেন এখনো তার সময় হয়নি । ভারতবর্ষে ফিরে এলেন স্বামীজি । ১৮৯৭ সালের ১ লা মে স্বামীজির ঐকান্তিক চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হল রামকৃষ্ণ মিশন । প্রচণ্ড মধ্যেও স্বামীজি মার্গারেটের সাথে যোগাযোগ রাখতেন । মার্গারেটের অন্তর ব্যাকুল হয়ে উঠত ভারতবর্ষ থেকে কবে তাঁর ডাক আসবে । অবশেষে স্বামীজি মার্গারেটকে চিঠিতে লিখলেন , — এদেশের দুঃখ , কুসংস্কার , দাসত্ব যে কত ভয়ানক তা তুমি ধারণা করতে পারবে না । এই দেশে আসবার পর তুমি নিজেকে অর্ধ উলঙ্গ অসংখ্য নরনারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে । তারা শ্বেতাঙ্গদের ভয়ে হোক ঘৃণায় হোক এড়িয়ে চলে এবং তারাও এদের তীব্র ঘৃণা করে । পক্ষান্তরেবিশ্ব মনীষী শতক ৫৮৮ শ্বেতাঙ্গরা তোমাকে ছিটগ্রস্ত মনে করবে , তোমার প্রতিটি গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখবে .......... যদি এসব সত্ত্বেও তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত সম্ভাষণ জানাচ্ছি । চিঠি পড়ে অভিভূত হলেন মার্গারেট । স্বামীজি তাঁকে ডাক দিয়েছেন ।


চিরপরিচিত জগৎ থেকে মার্গারেট যাত্রা করলেন ভারত অভিমুখে । ১৮৯৮ সালের ২৮ শে জানুয়ারি মার্গারেটের জাহাজ এসে ভিড়ল কলকাতার বন্দরে । স্বামীজি স্বাগত জানালেন আইরিশ দুহিতাকে । তাঁর থাকবার জায়গা ঠিক করা হল । চৌরঙ্গী অঞ্চলের এক হোটেলে । ইতিমধ্যেই স্বামীজীর কয়েকজন শিষ্য - শিষ্যা এসে উঠেছিলেন বেলুড়ের কাছে একটি বাড়িতে । মার্গারেট তাঁদের সাথে এসে যোগ দিলেন । স্বামীজি নিয়মিত তাঁদের নানান বিষয়ে শিক্ষা দিতেন । মার্গারেট অনুভব করলেন এদেশের মানুষের সাথে কাজ করতে হলে তাদের ভাষা শিখতে হবে । শুরু করলেন বাংলা ভাষা শেখা । একই সাথে পরিচিত হতে থাকেন এদেশের মানুষদের সাথে । ব্যাপক জনসমক্ষে মার্গারেটকে সকলের সাথে পরিচিত করবার জন্য ১৮৯৮ সালে ১১ ই মার্চ স্বামীজি স্টার রঙ্গমঞ্চে এক বক্তৃতা সভার আয়োজন করলেন । প্রথম বক্তৃতায় মুগ্ধ হলেন সকলে । অল্প কয়েকদিন পরেই শ্রীমা জয়রামবাটি থেকে এলেন বাগবাজারে বোসপাড়া লেনে । মার্গারেট শ্রীমার কাছে গেলেন ।

প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন । কেউ কারোর ভাষা বোঝেন না । কিন্তু অকৃত্রিম সরলতায় মার্গারেটকে কাছে টেনে নিলেন মা । স্বামীজির মনের সব সংশয় কেটে গেল । মা যখন মার্গারেটকে গ্রহণ করেছেন তখন আর কোন বাধা নেই । স্বামীজি মার্গারেটকে বললেন — তোমাকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেব ।

১৮৯৮ সালের ২৫ শে মার্চ দিনটি মার্গারেটের জীবনের এক পরম আনন্দের দিন । বেলুড় মঠের ঠাকুরঘরে এক পূজার আয়োজন করে স্বামীজি মার্গারেটকে দীক্ষা দিলেন । বললেন — এ জীবন তোমার নয় — এ জীবন ভগবানের । তাঁর ইচ্ছাতেই তোমার জীবন পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য উৎসর্গিত হবে । মার্গারেটের নতুন নাম দিলেন নিবেদিতা । এরপর থেকে তিনি নিজের নাম স্বাক্ষর করতেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের নিবেদিতা । স্বামীজির মৃত্যুর পর তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ায় তাঁকে রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় । তখন থেকে তিনি লিখতেন “ রামকৃষ্ণের বিবেকানন্দের নিবেদিতা ” । অত্যাধিক পরিশ্রমের কারণে স্বামীজির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় তাঁকে দার্জিলিং - এ নিয়ে যাওয়া হল । নিবেদিতা কলকাতাতেই থেকে গেলেন স্বামীজির দেওয়া দায়িত্ব পালন করার জন্য । হঠাৎ কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল । মহামারির মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তার ভয়াবহ প্রকোপ । বহু মানুষ মারা গেল । দলে দলে মানুষজন কলকাতা ছেড়ে পালাতে আরম্ভ করল । প্লেগের সংবাদ শুনে স্বামীজি কলকাতায় ছুটে এলেন । নিবেদিতাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আর্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য । নিবেদিতা রামকৃষ্ণ মিশনের কয়েকজননিবেদিতা ৫৮৯ সন্ন্যাসীকে নিয়ে পথে নামলেন । নিজের হাতে রাস্তাঘাটের জঞ্জালের স্তুপ পরিষ্কার করতে আরম্ভ করলেন । পাড়ার যুব সম্প্রদায়রাও তাদের হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে আরম্ভ করল । ধনীদের কাছে ভিক্ষা করে যে অর্থ পান তাই দিয়ে পথ্য কেনেন । দিন রাত আহার নিদ্রা ভুলে গিয়ে কাজ করে চলেন নিবেদিতা । ধীরে ধীরে প্লেগের প্রকোপ হ্রাস পেল । আবার মানুষ কলকাতায় ফিরে আসতে থাকে । স্বামীজি নিবেদিতা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে পর্যটনে বেরোলেন । আলমোড়া , নৈনিতাল প্রভৃতি জায়গায় গেলেন । খেতড়ির মহারাজা অভ্যর্থনা জানালেন স্বামীজিকে । নিবেদিতা অনুভব করলেন ভারতবর্ষেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর কাছেও নতজানু হয় রাজা মহারাজা । কিছুদিন আলমোড়ায় থেকে তাঁরা কাশ্মীর গেলেন । দীর্ঘ পর্যটন শেষে কলকাতায় ফিরে এলেন । এবার প্রকৃত মানবসেবা শুরু করার পালা । অল্পদিনেই নিবেদিতা অনুভব করেছিলেন এ দেশের নারীরা কি সাংঘাতিক দুরবস্থার মধ্যে বাস করে । তাদের কোনো শিক্ষা নেই , চরম অবহেলা আর হাজারো কুসংস্কারের বেড়াজালে তারা বন্দি । স্বামীজি বলতেন , নারীজাতি জাগলে তবেই ভারতবর্ষ জেগে উঠবে । শিক্ষার আলোকে নারীর মুক্তি লাভ ঘটবে । স্বামীজির আশীর্বাদ নিয়ে নিবেদিতা বাগবাজারে প্রতিষ্ঠা করলেন বালিকা বিদ্যালয় । একজন বিদেশি মহিলার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে কেউই তাদের মেয়েদের পাঠাতে সাহস করে না । সকলেই ভয় পায় যদি মেয়েরা খ্রিস্টান হয়ে যায় । বহু কষ্টে তিনজন ছাত্রীকে সংগ্রহ করা গেল । তাদের নিয়েই নিবেদিতা স্কুলের পঠন পাঠন শুরু করলেন । তাঁর অমায়িক ব্যবহার আর শিক্ষার গুণে অল্পদিনেই ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেল । ছাত্রীরা ছাড়াও দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যেও তিনি শিক্ষা দিতেন স্বদেশপ্রেমের । তিনি তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে চাইতেন সনাতন ভারতবর্ষের সমুহান আদর্শে । এবার স্বামীজি তাঁকে বিদেশযাত্রার জন্য ডেকে পাঠালেন । সাময়িক স্কুল বন্ধ রেখে নিবেদিতা আমেরিকায় গেলেন । এই বিদেশ ভ্রমণের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা । এরই সাথে চলতে থাকে বেদান্তের প্রচার এমন সময় ডাক এল প্যারিস থেকে । সেখানে বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দিতে জগদীশচন্দ্র বসু ও লেডি অবলা বসু এসেছিলেন । নিবেদিতার সাথে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল । কয়েকমাস পরে নিবেদিতা ও বসু দম্পতি ইংল্যান্ডে গেলেন । ইংল্যান্ডে এসে জগদীশচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর অপারেশন হল । নিবেদিতার অক্লান্ত সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন । এখানে বসেই লিখলেন ' The web of Indian life ' ভারতে ফেরার জন্য নিবেদিতার মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল । প্রথমে উঠলেন মাদ্রাজে তারপর আবার সেই বাগবাজার পল্লী । nung half sa ১৯০২ সালে স্বামীজি অসুস্থ হয়ে পড়লেন । একদিন নিবেদিতা গিয়েছিলেন বেলুড় মঠে স্বামীজিকে দেখতে । স্বামীজি তাঁকে বললেন , — আজ তুমি আমার কাছে খাবে । খাওয়া শেষে নিজেই নিবেদিতার হাত ধুইয়ে মুছিয়ে দিলেন । ত ৫ ই জুলাই সংবাদ এল স্বামীজি নেই । স্বামীজির মৃত্যুতে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেন নিবেদিতা । তাঁর জীবনে ঘটে গেল বিরাট এক পরিবর্তন । স্বামীজির শিক্ষাতেই যে তাঁর

 সব কিছু গড়ে উঠেছে । ঈশ্বরসেবা নয় , মানব সেবাই যে তাঁর সাধনা । যুগ যুগাত্তরের জড়তাকে কাটিয়ে ভারতবর্ষের যুব সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তুলতে চেয়ে ছিলেন । তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের কাছে জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক । স্বামীজির মৃত্যুর শুরুর সব দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন নিবেদিতা । তাঁর কাছে ভারতবর্ষ আর তার মানুষের মুক্তি সাধনাই একমাত্র ব্রত হয়ে উঠেছিল । একে একে নিবেদিতার সাথে পরিচয় হল এদেশের সেই যুগের দেশবরেণ্য মনীষীদের সাথে । তাঁদের মধ্যে ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখেল , শ্রী অরবিন্দ , সরোজিনী নাইডু , বিপিনচন্দ্র পাল , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , সুরক্ষণ্য ভারতী । পর নিবেদিতা ভারতবর্ষের এক প্রাপ্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ালেন । বহু বিপ্লবীর সাথে তাঁর পরিচয় হল । বরোদায় দেখা হল শ্রীঅরবিন্দের সাথে । নিবেদিতার ডাকে বাংলায় এলেন স্ত্রী অরবিন্দ । নিবেদিতা প্রসঙ্গে শ্রী অরবিন্দ বলেছিলেন , তিনি যেন এক বিদ্যুতের শিক্ষা । নিবেদিতার আহ্বানে তিনি বাংলায় এসে হয়ে উঠলেন সশস্ত্র বিপ্লবগুরু । রাজনীতির সাথে নিবেদিতার এই সরাসরি সম্পর্ককে মেনে নিতে পারলেন না বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা । বলা হল , রাজনীতির সাথে নিবেদিতাকে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে । কিন্তু নিবেদিতার জীবন যে এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্যই উৎসর্গীকৃত । বেদনাহত চিত্তে তিনি বেলুড়মঠের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন । এই সময় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন । এই সোসাইটি কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে উঠল তরুণ বিপ্লবীদের শিক্ষাকেন্দ্র । মাঝে মাঝে নিবেদিতা সোসাইটির সভায় যোগ দিয়ে বক্তৃতা দিতেন , তাদের পত্রিকায় লিখতেন । নিবেদিতা সম্পর্কে গোখেল লিখেছেন , তিনি ভারতবর্ষকে নিজের জীবনের সাথে যেভাবে একাত্ম করেছেন তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না । জাতীয় চেতনা জাগ্রত করবার ক্ষেত্রে তিনি যা করেছেন , ইতালির বিপ্লবী নেতা ম্যাৎসিনির সাথেই তার তুলনা করা যায় । বিপ্লবীদের সাহায্য করার সাথে সাথে ভারতে বিজ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকেন । ' বসু বিজ্ঞান মন্দির ’ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর উৎসাহ ছিল সবথেকে বেশি । যদিও নিবেদিতা বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার বহু আগেই দেহত্যাগ করেন । কিন্তু তাঁর স্বরণে জগদীশচন্দ্র বসু মন্দিরের দ্বারে দাপহাতে নারীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন । অক্লান্ত পরিশ্রমে নিবেদিতার স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল । কিন্তু বিশ্রাম নেবার তো কোনো উপায় নেই । বাড়িতে দিবারাত্র লোকজনের ভিড় । তারই সাথে বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখা দিতে হয় । মাঝে মাঝে বক্তৃতাও দিতে হয় । কাউকেই ফেরাতে পারেন না । কর্মের ভারে খাওয়া ঘুমের সময় ঠিক থাকে না । অসুস্থ হয়ে পড়লেন নিবেদিতা । ডাক্তার নীলরতন সরকারের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠতেই আবার কর্মযজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়লেন । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই নিবেদিতা আকৃষ্ট হলেন ভারতের গৌরবময় অতীতের শিল্পরীতির প্রতি । ১৯০৬/৭ সালে অজন্তা গুহাচিত্রের অনুলিপি করার জন্য নিবেদিতার প্রচেষ্টায় নন্দলাল বসু , অসিত হালদার সহ কয়েকজনকে পাঠানো

হল । সেই জনবসতিহীন অঞ্চলে তাঁদের কষ্টের কথা ভেবে কয়েক দিন পরেই একজন পাচক আর নানান জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিলেন নিবেদিতা । ‘ ' বন্দেমাতরম ' পত্রিকার সম্পাদক স্বামীজির ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে সরকার বিরোধী রচনা প্রকাশিত করার জন্য এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হল । নিবেদিতা ভূপেন্দ্রনাথকে ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করলেন । কিন্তু ব্যর্থ হলেন । ইংরেজের রোষদৃষ্টি ক্রমেই এসে পড়ছিল নিবেদিতার উপর । বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে জগদীশচন্দ্র তাঁকে যুক্ত করলেন বিজ্ঞান আর সাহিত্যের কাজে । প্রকাশিত হল • Credle tales of Hinduism " । বাংলার আকাশে বাতাসে তখন বিপ্লবের আগুন জ্বলছে । শ্রী অরবিন্দ তখন ' কর্মযোগীন ' পত্রিকায় লিখছেন যোগ আর কর্মের বাণী । পুলিশের রোষদৃষ্টি এসে পড়ল শ্রী অরবিন্দের উপর । নিবেদিতা জানতে পারলেন শ্রী অরবিন্দকে বন্দি করা হবে । গোপনে নিবেদিতা তাঁর সাথে দেখা করে প্রয়োজনীয় অর্থ তাঁর হাতে তুলে দিয়ে অরবিন্দকে পণ্ডিচেরীতে চলে যেতে বলেন । শ্রী অরবিন্দ পণ্ডিচেরী চলে গেলে তাঁর ' কর্মযোগীন ' পত্রিকার দায়িত্বভার নিজের হাতে তুলে দিলেন নিবেদিতা । প্রকাশিত হল তাঁর একের পর এক প্রবন্ধ । আতঙ্কিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা বন্ধ করে দিল তাঁর ' কর্মযোগীন ' পত্রিকা । কিছুদিনের জন্য আমেরিকায় গেলেন নিবেদিতা । উদ্দেশ্য ছিল ' বসু বিজ্ঞান মন্দির'এ জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করা । আশাহত হৃদয়ে ফিরে এলেন কলকাতায় । ততদিনে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে । জগদীশচন্দ্র পরামর্শ দিলেন দার্জিলিং যাবার । নিবেদিতা রাজি হলেন । তুষারশুভ্র হিমলয়ের রূপ দেখে আত্মমগ্ন হয়ে গেলেন । কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমশই অবনতি ঘটতে থাকে । বুঝতে পারলেন তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছে । নিজের সমস্ত অর্থ তুলে দিলেন বে লুড় মঠের হাতে । বললেন , —এই অর্থ যেন মেয়েদের শিক্ষার প্রচারের কাজে ব্যয় করা হয় । ১৯১১ সালের ১৩ ই অক্টোবর চিরনিদ্রায় ডুবে গেলেন নিবেদিতা । মৃত্যুর আগে অস্ফুট স্বরে বললেন— “ The boat is sinking . But I shall see the sunrise'— নৌকা ডুবছে কিন্তু আমি সূর্যোদয় দেখব । এই আলোর সাধনাই ছিল তাঁর সারা জীবনের সাধনা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ