মধুমালতী
--লীলা মজুমদার
বহুদিন আগেকার কথা , যখন আজকাল যা ’ যা ’ ঘটে থাকে সে সমস্তই ঘটত , তখনকার কথা । রাণীমা বড় রাজকন্যে মেজ রাজকন্যে আর মাসতুতো বোন মধুমালতীকে ডেকে বললেন , “ পরীদিদি আসছেন অতিথি হ’য়ে , দেখিস্ তাঁর যেন অমর্যাদা না হয় ।
যেন আবার অপমান হয়ে রেগেমেগে শাপ - খোপ দিয়ে না বসেন । জানিস ত ’ রাজার রাজকোষ গড়ের মাঠ , উজির নাজিরদের তিনমাসের মাইনে বাকী , জাহাজঘাঁটির জাহাজ সব চাঁচাপোছা , মহারাজের লাল পাথর বসান মুকুটটা পর্যন্ত থিয়েটার কোম্পানিকে বাঁধা দেওয়া হয়েছে । উপরন্তু তোদের কারুর বিয়ে হয় নি ।
হবার বিশেষ লক্ষণও দেখি না । তাই বলি যা’র পরীদিদি নেই , তা’র কেউ নেই । বড় রাজকন্যে , মেজ রাজকন্যে রেগে বল্লেন , “ কেন আমাদের বিয়ে হবে না ? আমরা রাজার মেয়ে , আমাদের রূপগুণ কোনটা কম শুনি ? বিয়ে না হয় , ত ’ ঐ মধুমালতীর না হতে পারে । রান্নাঘরে দিন কাটে , চোখ মুখে ঝুলকালি , না আছে একটা ভালো সাড়ী , না আছে একটা ভালো গয়না । মাগো কি ঘেন্না ! ” মধুমালতী চোখ নীচু করে রাণীমার পায়ের দিকে চেয়ে রইল ।
রাণীমা বল্লেন , “ ছি , ছি গরীব মানুষকে টিকিরি দিতে নেই । খেতে পেত না , পরতে পেত না ; তাই ঘরে ঠাঁই দিয়েছি , তাই নিয়ে আর খোঁটা দিস্ নে ! তোমাকেও বলি বাছা , তোমার ভরসাতেই খানসামা তাড়ালাম , তা রান্নাবান্নাগুলো যদি একটু মনের মত হয় । পরীদিদি কী যে মনে করবেন কে জানে ! ”
মাসতুতো বোন মধুমালতী তবু চোখ নীচু করে চুপ করে রইল । বড় রাজকন্যে বললেন , “ আমরা তো পরীদিদিকে নেমতন্ন করিনি তবু কেন আসছেন ? ” মেজ রাজকন্যে বললেন , “ যেচে যখন আসছেন , যে রকম ব্যবহার করবেন , সেইরকম ব্যবহার পাবেন । ” বড় রাজকন্যে শুধোলেন , পরীদিদির কি অনেক সোনাদানা হীরে মুক্তো আছে ? তিনি কি চার ঘোড়ার টানা জুড়িগাড়ি চড়ে আসবেন ? সঙ্গে কি একশ ’ দাসদাসী আসবে ? একশ ’ উটের পিঠে চাপিয়ে কি তিনি আমাদের জন্য উপহার আনবেন ? রাণীমা গালে হাত দিয়ে বললেন , “ ওমা বলে কি ! একশ ’ উট থাকবে কোথায় ? পশুশালা ত ’ সার্কাস কোম্পানি ভাড়া নিয়েছে । একশ ’ দাসদাসী খাবে কি ! তোরাই ত ’ দিনরাত খাই খাই করিস । তোমাকে বলি বাছা মধুমালতী খাবারদাবারগুলো না হয় বিশ্রী করেই রাধলে , পরিমাণটাও কি বাড়াতে পার না ? ” মেজ রাজকন্যে বললেন , “ পরীদিদি কি জ্যোৎস্না রাত্রির মত রূপসী ? তাঁর চুলগুলো কি মেঘের মত নরম ? তাঁর চোখ দুটো কি তারার মত উজ্জ্বল । কথা বললে কি তাঁর মুখ থেকে গোলাপ ফুল আর মুক্তো ঝরে পড়ে ? তাঁর গলার আওয়াজ কি বসন্তকালের কোকিলের মত ? ” তাই শুনে রাণী মা নড়বড়ে সিংহাসনে বসে পড়লেন ।
বললেন “ কি জানি বাছা !
তোর দিদির অন্নপ্রাশনে শেষ দেখেছিলাম । বয়স মনে হয়েছিল ষাট বছর । মাথায় দু’গাছি পাকা চুল ছিল । ঝাঁকায় চেপে এসেছিলেন , খালি হাতে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে । সঙ্গে উট টুট কিন্তু ছিল না ; তবে একটা কালো বেড়াল ছিল ।
গলার আওয়াজটা ছিল ভাঙ্গা হাড়ির ভেতর খুন্তি ঘষলে যেমন শোনায় , অনেকটা তাই । ” নাক সিঁটকে দুই রাজকন্যে একসঙ্গে বলে উঠলেন , “ মা গো , কি ঘেন্না ! ” রাণীমা তাই শুনে মধুমালতীকে বললেন , “ আর তোমাকেও বলে রাখি বাছা মধুমালতী , গরীব আছ , গরীবের মত থাকবে । পরীদিদির সঙ্গে বেশী ঘেঁষাঘেঁসি করতে গিয়ে যেন আবার তাঁকে চটিয়ে দিও না । ”
মেয়েদের সাবধান করে দিয়ে বললেন ,
“ দেখিস যেন বেখাপ্পা কিছু বলিস নে । যা রাগী মানুষ , এক কথায় তোদের একেকটাকে গিরগিটি বানিয়ে দিতে পারেন তা মনে রাখিস ।
এখন যা , তোদের নীল রং - এর হাওয়াই শাড়ি পরে , মুখে লোথ্ররেণু মেখে , আলোর দিকে মুখ করে , ফুলের মালা আর চন্দন বাটা নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়া , পরীদিদির অভ্যর্থনা করতে হবে ।
আর তোমাকেও বলি বাছা মধুমালতী , সাজসজ্জার সঙ্গে তোমার কি ? রান্নাঘরে গিয়ে বরং মুখে দেবার যুগ্যি কিছু রেখো । ” মধুমালতী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল , “ পরীদিদি আমার জন্য কিছু আনবেন না ?
রেশমি শাড়ি , ফিরোজার গয়না , আনবেন না ? রাজপুত্র বর আনবেন না ? ” শুনে রাজকন্যেরা আর হেসে বাঁচেন না ।
“ আরে তোর জন্যে আনবেন কেন রে ? তুই হলি গিয়ে গরীব । আনেন যদি আমাদের জন্যে আনবেন ।
আমরা হলাম রাজকন্যে । ” মধুমালতী মুখখানা কালী করে রান্নাঘরে গিয়ে গুটিকতক আলু , আধ সের দুধ আর দুটো তিতির পাখী দিয়ে রান্না চড়ায় । তার মন ভালো নেই ।
বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে , এমনি সময় পিছনের দরজা দিয়ে , এক মুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে , রোগা ডিগডিগে একটা লোক , মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল , “ এই আমার উট দেখেছ , আমার ন্যাড়া মতন উট ? ” চমকে গিয়ে মধুমালতী খুন্তি উচিয়ে বললে “ এই ও ! ভাগো ! তারপর চোখ তুলে লোকটার মুখের দিকে চাইল ।
চেয়ে অবাক হলো । দেখল তা'র দাঁড়িগোঁফের ফাঁকে ফাঁকে রূপের ছটা । তার খাকি রং - এর আধময়লা কুর্তো পেন্টলুন তার দেহের দিব্য কান্তি গোপন করতে পারছে না । লোকটা একটু বিরক্ত হয়ে বললে , “ উটটা কোথায় রেখেছ বল না । পড়ান উট গো । ” উট না হলে উটের খেলা দেখাব কি করে ? আহা , আমার অমন শেখান মধুমালতীর হৃদয়খানা খাঁচায় বন্ধ পাখীর মত ডানা ঝাপটাতে লাগল ক্ষীণ কণ্ঠে সে বললে , “ অমন উট উট কর না বলছি । উট দেখলে আমি ভয়ে
লোকটা ঘরের ভেতরে একটু সেঁদিয়ে বললে , “ বাঃ বেশ গন্ধ বেরুচ্ছে ত । এইখানে এই টুলটাতে একটু বসি ? ” মধুমালতী ভালো করে কথা না শুনেই বললো , “ হু । ” কিন্তু খবরদার তিতির পাখির ভাগ চেয়ো না ।
তুমি তিতির পাখি খেয়ে ফেললে ' পরীদিদি কি খাবেন ? আর পরীদিদি খেতে না পেলে সে রেগে মেগে রাজকুমারী দিদিদের আর আমাকে এককথায় গিরগিটি বানিয়ে দেবেন ! তখন আমাদের বিয়েও হবে না , শাড়ি গয়নাও পরা হবে না ।”
লোকটা বললো , “ কেন বিয়ে হবে না ? তোমার মত যে রাঁধে তার একশবার বিয়ে হবে । পরীদিদি এসব খাবেন না । দু’রকম পরী হয় ।
এক নম্বর পরীরা মধু খায় আর দু'নম্বর পরীরা গন্ধকের ধোঁয়া খায় , তিতির পাখীর মাংস পরীরা খায় না । ” ব’লে তিতিরের একটা ঠ্যাং ছিঁড়ে তক্ষুণি সেটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো , মধুমালতী আপত্তি জানাতে গেলে তাকে বাধা দিয়ে বললো , “ জান আমি দেখতে এই রকম কিন্তু আমার জীবনে একটা বড় দুঃখ আছে ! ”
শুনে মধুমালতীর মনটাও হাহাকার করে উঠল । তিতিরের কথা সে ভুলে গেল ! লোকটা আবার বললো , “ বাইরে দেখছ কেমন কোট পেন্টেলুন পরে দিব্যি উট খুঁজে বেড়াচ্ছি , কিন্তু বুকের ভেতরটা আমার শূন্য খাঁ খাঁ করছে ।”
মধুমালতী চোখ দুটিতে কালো দীঘির জলের মত জল ছাপিয়ে এল ।
লোকটি বলল , “ পৃথিবীতে কে সত্যিকারের সুখী বলতে পার ? যার রূপ - গুণ - ধন - দৌলত আছে , সে নয় । যার প্রেম - ভালবাসা , স্বাস্থ্য - শান্তি আছে , সে নয় ।
কেবল সেই সত্যিকারের সুখী লোক , যার ঘরে ভালো রাঁধুনি আছে ; একথা সত্যি নয় কি ?
আমার মত দুঃখী বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কেউ নেই ! ভাবতে পার , আমার সার্কাস পার্টিতে পঞ্চাশ জন লোক আছে , তাদের মধ্যে একজন রাঁধতে পারে না ?
ভাবতে পার , আমি ছ'মাসে একষট্টি জন রাঁধুনি তাড়িয়েছি ? ভাবতে পার , সাত বছরে আমি সাতবার ভালো করে খেতে পাইনি ?
জান , আমার হৃদয়টা কানায় কানায় কান্না দিয়ে ভরা ? ”
মধুমালতী আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো । লোকটা আড়চোখে তাকিয়ে তিতিরের অন্য ঠ্যাংটাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলে বললো , “ কেঁদে আর কী হবে ? সুখ আমার কপালে লেখা ছিল না , আর কী হবে ? এক যদি— "
মধুমালতী চোখ মুছে উৎকণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করল , “ এক যদি— কি ? ” “ না ! “ যা হবার নয় তা ' ভেবে লাভ কি ? তুমি কি আর এই সুখের বাসা ছেড়ে আমার গরীব ঘরে ঠাঁই নেবে ! ”
মধুমালতীর বুকের ভিতর শঙ্খ ঘণ্টা বেজে উঠল । কী হবে রাজপুত্র কোনদিন হয়ত আসবে না , কী হবে তাকে দিয়ে ! উঠে দাঁড়িয়ে সে বললে , “ কেন যাব না ! —অন্য তিতিরটাও খেয়ে ফেল । আজ আমি কাউকে কেয়ার করি না । ” তিতির খেয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে লোকটা বললো , “ সত্যি তুমি অনন্যসাধারণ , তুমি অনিন্দিত । দুনিয়াতে তোমার মত কেউ নেই । শেষটা তুমিও ঐ একষট্টি জনের মত আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না ত ? মধুমালতী বললে , “ তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না ? ” দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বললে , “ দুঃখে দুঃখে পৃথিবীটাকেই বিশ্বাস হারিয়েছি ! তা ছাড়া বাবা বলতেন স্ত্রীলোককে কদাচ বিশ্বাস করতে নেই । আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না , এস না আমরা বিয়ে করে ফেলি ? দেখ , আপত্তি ক'র না । পরীদিদি কি ছাই দেবে রাজকন্যাদের ? আমি তোমাকে যে সব লাল নীল ডোরা কাটা ফুটকি দেওয়া শাড়ি দেব , হীরে মুক্তো বসান গয়না দেব , তাই দেখে রাজকন্যাদের কেন স্বয়ং পরীদিদির চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে । — আচ্ছা রাঁধতে তোমার কোনও আপত্তি নেই ত ? ” দু'বেলা পঞ্চাশ জন লোকের জন্য ? ” মধুমালতী ব্যাকুলভাবে বললো , “ গোটা সার্কাস পার্টির জন্য ? রোজ “ আরে দূর ! ওরা নিজেরা রেধে খাবে । আমার বৌ একা আমার জন্য রাঁধবে । ‘ না ’ বোল না । তা হলে আমি বুক ফেটে মরে যাব । না হয় , যেদিন তোমার রাঁধতে ইচ্ছা করবে না , সেদিন ছুটি নিও । কিন্তু ‘ না ’ বল না । আমরা
সেদিন হোটেলে খাব । ”
মধুমালতী সগর্বে বললো , “ রোজ আমি খুশি হয়ে তোমার জনে রেঁধে দেব । ” লোকটাও হয়ে বললো , “ তবে আমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করে আছি ।
চল , পুরুত ঠাকুর আজ কমপ্লেমেন্টারি টিকিট পেয়ে সার্কাস দেখতে এসেছেন ! এই ত ’ পরম শুভ মূহুর্ত ” মধুমালতী বললো , “ কিন্তু পরীদিদি যদি রেগে রাজকন্যাদের বর না “ কুছ পরোয়া নেই । আমি বর দেব । আমার দুই ম্যানেজারের সঙ্গে দু’জনার বিয়ে দেব । “ যদি রেগে গিয়ে ওদের গিরগিটি বানিয়ে দেন ? ” “ তা হলে ত ’ ভালই হয় । রোজ আমি গিরগিটির খেলা দেখাব । চল আর বিলম্ব কিসের ? ঐ দেখ হাম্বা হাম্বা করে ডাকতে ডাকতে উটটাও এসে উপস্থিত হয়েছে ।
”
0 মন্তব্যসমূহ