খনার বচন অর্থ সহ বাংলা।(Khanar Bachan with meaning)

           ** খনার জীবনী : ** 

খনার জন্ম বৃত্তান্ত সম্বন্ধে প্রচলিত গল্প থেকে জানা যায় যে , এক সময় রাক্ষস ময়দানব লঙ্কা দ্বীপের রাজা ছিলেন , আর খনা তাঁরই কন্যা । কালক্রমে ময়দানবের শত্রুপক্ষীয় রাক্ষসেরা ময়দানবকে সবংশে ধ্বংস করে । শুধুমাত্র খনার প্রতি স্নেহ পরবশ হয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখে আর তার মধ্যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে তাকে জ্যোতিষ শাস্ত্র শেখাতে আরম্ভ করে। খনাও কালে কালে জ্যোতিষ বিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠে ।ওই সময়েই মালাবারের চুম্বী গ্রামের অধিবাসী এবং মহারাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভার সভা - পণ্ডিত জ্যোতির্বিদ বরাহের একটি পুত্রসন্তান জন্মায় এবং বরাহ তার নামকরণ করেন মিহির । জন্মাবার অল্প সময়ের মধ্যেই বরাহ মিহিরের আয়ু গণনা করেন , কিন্তু গণনায় তাঁর ভুল হয় আর মিহিরের আয়ু মাত্র এক বছর বলে তিনি জানতে পারেন । এই অবস্থায় তাঁকে যাতে স্বচক্ষে মিহিরের অকাল মৃত্যু না দেখতে হয় , সেজন্যে তাকে একটি তামার পাত্রের মধ্যে রেখে , পাত্রটি সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেন । দৈবযোগে সেই তামার পাত্রটি ভাসতে ভাসতে একসময় লঙ্কা দ্বীপের সমুদ্রতীরের কাছে গিয়ে পৌঁছায় । সেইসময় খনা তার রাক্ষসী সহচরীদের সঙ্গে সমুদ্রে স্নান করছিল , সে ওই তামার পাত্রের মধ্যে ওই সুন্দর শিশুটিকে দেখতে পায় এবং তাকে জল থেকে তুলে নেয় । সঙ্গে সঙ্গে খনা সেই শিশুটির আয়ু গণনা করে দেখে যে , তার আয়ু একশো বছর । 

বাড়ি গিয়ে খনা শিশুটিকে রাক্ষসদের হাতে সমর্পণ করে । রাক্ষসেরা তাকেও লালন - পালন করতে থাকে , তাকেও জ্যোতিষ বিদ্যা শেখায় । কিছুদিন পরে মিহিরকে উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করে , তারা খনার বিয়ে দেয় মিহিরের সঙ্গে । এইভাবেই মিহির রাক্ষসদের মধ্যে প্রতিপালিত হতে থাকে এবং সেও জ্যোতিষ বিদ্যায় অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হয় । কিছুদিন কেটে যাবার পর জ্যোতিষ গণনার সাহায্যে মিহির নিজের জন্ম বৃত্তান্ত জানতে পারলো । ক্রমে নিজের জন্মভূমি দেখার ইচ্ছা তার মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠলো আর সেই কথা সে খনাকেও জানাল । সেই অনুসারে কয়েকদিনের মধ্যেই একদিন মাহেন্দ্রক্ষণ দেখে নাও মিহিরের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো তার শ্বশুরবাড়ির পথে । এই খবর প্রধান রাক্ষসের কাছে পৌঁছুতে দেরি হলো না । কিন্তু সে এদের যাত্রার বিরোধিতা করলো না বরং গণনা করে দেখলো যে তারা মাহেন্দ্রক্ষণে যাত্রা করেছে , তাই তাদের কোনো বিপদ হবে না । সে তার রাক্ষস ভৃত্যের হাতে ভূ - তত্ত্ব ,খ - তত্ত্ব ও পাতাল - তত্ত্ব সম্বন্ধে তিনখানা গ্রন্থ দিয়ে বললো যে , ওদের সমুদ্রের ওপারে রেখে এসো , আর মিহিরকে একটি প্রশ্ন কর , যদি সে সঠিক উত্তর দিতে পারে , তাহলে তিনখানা গ্রন্থই তাকে দিও , আর উত্তর ঠিক না হলে পাতাল - তত্ত্ব গ্রন্থটি তাকে দিও না । সমুদ্রের পারে পৌঁছুবার পর সেখানে তারা দেখলো যে একটি গরুর প্রসব বেদনা উপস্থিত হয়েছে । ভৃত্য মিহিরকে প্রশ্ন করলো



খনার বচন ৪ ভাগে বিভক্ত- 

১)কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার,

২) আবহাওয়া জ্ঞান

৩) শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ। 

৪) নানা রকম প্রকৃতিক দুর্যোগের আন্দাজ করে ফসল রক্ষার জন্য অনেক বচন দিয়েছেন। 

[শস্যাদি রােপণ, শস্যাদি গণনা, শস্য সাফল্য, শস্য কর্তন,হাল গণনা, কুয়াশা গণনা, প্রভৃতি ফসল বিচার গণনা ইত্যাদি]


       ১) এক অঘ্রানে ধান । 
           তিন শাওনে পান ।। 
 
অর্থঃ এক অগ্রহায়ণের মধ্যেই যতদূর সম্ভব ধান হয় । আর পান গাছ তিন শাওন গত হইলে ভাল রুপে জন্মায় ।

       ২) কার্তিকের উনো জলে 
          দুনো ধান খনা বলে ।

 অর্থঃ কার্তিক মাসে যদি অল্প অল্প বৃষ্টি হয়, তাহা হইলে দ্বিগুণ ধান্য সেই বৎসরে উৎপন্ন হইয়া থাকে।

৩) অঘ্রানে পৌটি ।

পৌষে ছেউটি ।

মাঘে নাড়া ।

ফাল্গুনে ফাড়া ।


অর্থঃ ধান্য ষোল আনা লাভ হয় যদি অগ্রহায়ণ মাসে কাটা হলে যায়। পৌষে ছয় আনা লাভ, মাঘে খড় মাত্র (নাড়া) এবং ফাল্গুনে সমস্ত ধান নষ্ট হয়।


     ৪)  শীষ দেখে বিষ দিন।                               কাটতে মাড়তে দশ দিন ।।

অর্থঃ ধান্যের শীর্ষ যেদিন বাহির হইবে, সেইদিন হইতে কুড়ি দিন পরে ধান্য কর্তন করিতে হইবে এবং তারপর থেকে দশদিনের মধ্যে ধান কেটে মাড়াই করিতে হইবে।
             ৫) আউশ ধানের চাষ ।
                  লাগে তিন মাস ।।

অর্থঃ আউশ ধান্য রোপণ ও কাটিবার সময়ের মধ্যে তিন মাস গত হইয়া থাকে

           ৬) সরিষা বুনে কালাই মুগ ।
               বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক ।

অর্থঃ একই ক্ষেত্রে সরিষা ও কলাই অথবা সরিষা ও যুগ রোপণ করিলে, দুইটি ফসলই পাওয়া যায়। সেই কারণে কৃষকেরাও নিশ্চিন্তে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারে।

         ৭) ষোল চাষে মূলা।
              তার অর্ধেক তুলা ।।
              তার অর্ধেক ধান।
             বিনা চাষে পান ।।

অর্থঃ ষোল দিন চাষ করার পর সেই জমিতে মূলা চাষ করলে ভাল জাতের ফলন পাওয়া যায়। তুলা লাগানোর জমিতে আট দিন চাষ করতে হবে, ধানের জমিতে চার দিন চাষ করে ধান লাগালে ভাল ফলন পাওয়া যায়। পানের জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না।


       ৮) বলদ যদি না বয় হাল।
            তার দুঃখ চিরকাল।।

অর্থঃ ঘরে বলদ থাকতেও যে মায়া করে খাটায় না, তার বলদ শুধু বসে খায়। তার জমিতে চাষ আবাদ হয় না। না হওয়ার দরুন ঘরে অন্নের অভাব হয়।


       ৯) কোল পাতলা ডগার গুছি ।
             লক্ষ্মী বলেন হেথায় আছি।।

অর্থঃ মোটা মোটা গুছি দিয়ে খুব ফাঁক ফাঁক করে ধান রোপণ ধান বেশি পরিমাণ পাওয়া যায়।


১০) মাঠে গিয়ে আগে কর দিক নিরূপণ 
পূর্ব দিক হতে করহ হাল চালন।
খনা বলে মাের কথা শুন মহাশয়।
ফসল ফলিবে অধিক নাহি সংশয়।

অর্থ: মাঠে গিয়ে সবার আগে দিক নির্ণয় করে নিয়ে পূর্বদিক হতে হাল চালনা করতে হয়। যে তা করে সে অত্যধিক ফসল পায়।

১১) খনা বলে হাল নিয়ে মাঠে যবে করিবে গমন।আগে দেখে চাষী ভাই
 যেন হয় শুভক্ষণ ।

অর্থ: শুভক্ষণ দেখে সদা করিবে যাত্রা। পথে যেন না হয় অশুভ বার্তা। হাল চালাতে যেতে হলে শুভ দিন দেখে হাল নিয়ে মাঠে যাওয়া উচিত। পথের মধ্যে যদি অশুভ সংবাদ পাওয়া যায় তাহলে মাঠে না গিয়ে বাড়ী ফিরে আসাই যুক্তিযুক্ত 

   
 
   ১২) পূর্নিমায় আর অমায়
          যে ধরে হাল।
         তার দুঃখ থাকে চিরকাল।
         তার বলদের হয় বাত 
         নাহি থাকে ঘরে ভাত।।
         খনা বলে শোনরে বাণী। 
         হাল ধরিব্ব দুঃখ গণি।।

     অর্থ: অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় হাল ধরিতে নাই। যে ধরে তার দুঃখ চিরকাল বাঁধা থাকে। বলদ বাতে পঙ্গু হয়ে যায়। নানা কারণে তার চাষ নিষ্ফল হয়। ঘরে অন্নাভাব দেখা দেয়।

       
      বাড়ির কাছে ধান গা। 
       যার মার আছে ছা।
      চিনিস বা না চিনিস। 
       খুঁজে দেখে গরু কিনিস।
      চাল ধান দুই সস্তা। 
      মিষ্টি হবে লোকের কথা।

অর্থঃ বাড়ীর কাছে যদি জমি, সবার আগে সেই জমিতে চাষ আবাদ করা উচিৎ। তাতে চুরি যাবার ভয় থাকে না। গরু চেনার উপায় জানা থাক বা না থাক খুঁজে দেখে গরু কেনা উচিৎ।
    
      


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ