ময়নামতী
রাজার ছেলে মোহনলাল স্বপন দেখে ঘুম থেকে উঠেছে , কৃষ্ণপুর রাজ্যের রাজকন্যা ময়নামতী যেন তাকে বিয়ে করেছে । কৃষ্ণপুর রাজ্য যে কোথায় তা - ই তো সে জানে না , তায় আবার সেই দেশের রাজকুমারী ময়নামতী — যার রূপের গরবে মাটিতে পা পড়ে না — তাকে সে দেখবে কি করে । ভাব্লে , তাকে যখন সে স্বপনে দেখেছে আর তার বিয়েও হয়েছে , কাজে কাজেই তাকে যে করেই হোক খোঁজখবর করে বের করা চাই - ই , — আর তাকে ছাড়া অন্য কাউকে সে জীবনে বিয়েই করবে না । হরিণ শিকারের নাম করে একদিন রাজা আর রাণীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে একটা বনের মধ্যে এসে ঘোড়াটা ছেড়ে দিলে । দিয়ে , রাজপোষাক খুলে একটা পোঁটলা বেঁধে নিয়ে সাধুর বেশ পরে পথ চলতে লাগ্লে । দুপুরের রোদ মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ করছে , কাক পক্ষীর রা নেই । যেতে যেতে এক রাজার রাজ্য ছেড়ে আর এক রাজার রাজ্য । বনের মধ্যে মস্ত একটা বট গাছ , – সেই গাছের ছায়ায় মোহনলাল ক্ষিদেয় তেষ্টায় কাতর হয়ে শুয়ে পড়লো । পড়তেই অঘোরে ঘুম । - যখন প্রায় বেলা ডোবে ডোবে , এম্নি সময়ে তার ঘুম ভাঙ্গে । ঘুম ভাঙতেই সে শুনতে পেলো , গাছের ওপরে এক শুকপাখী শারীকে বল্ছে , “ আজ এই রাজপুত্রের নিশ্চয় মরণ হবে । ”
শারী জিজ্ঞেস করলে , “ কেন ? ” সে বললে , “ এক্ষুণি একটা বাঘ আসবে , এসেই রাজপুত্রকে খেয়ে ফেলবে । ”
“ আহা , তবে তো খুব দুঃখের কথা ! তা এঁকে কোন রকমে বাঁচানো যায় না ? ”
“ নাঃ , তা কি করে হবে ; তবে একটা উপায় হতে পারে । বাঘটা আসতেই যদি রাজপুত্র তাকে ' মামা ' বলে ডেকে কাছে যায় তা হলে সে আর কিছু বলবে না । ”
নীচে থেকে রাজপুত্র সব শুনতে পেয়ে আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসে রইলো ৷ এদিকে খানিক পরে বন - বাদাড়কাঁপিয়ে ‘ হালুম ’ ‘ হালুম ' ক'রে একটা বাঘ ঝোপের মধ্যে আসতেই রাজপুত্র উঠে তাকে একটা প্রণাম করলো । বললে , “ কি মামা কেমন আছো ? ” বাঘ তো ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল । এ বলে কি ! মানুষ আবার তার বোনপো হবে কি করে ! বেচারী খানিকক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমতা আমতা করে বললে , “ তা ভাগ্নে কেমন আছো ? আমাদের বাড়ী চলো । ”
বাঘ তাকে সাথে করে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গেল । বাঘের ছেলেপুলেরা একজন মানুষ ভাই পেয়ে তার গা চেটে আনন্দ জানাতে লাগলে । বাঘিনী তাকে আদর করে মরা গরুর একটা ঠ্যাং তাকে খেতে দিলে । রাজপুত্র দু’একদিন তাদের কাছে থেকে বাঘ বাঘিনী আর তার ছেলেপুলেদের কাছে বিদায় নিতে গেল ।
তারা বলে , “ যদি কোনো বিপদ আপদ হয় — ‘ মামা ’ ‘ মামা ’ বলে ডেকো — তাহলেই আমরা গিয়ে হাজির হবো । ”
রাজপুত্র স্বীকার করে তাদের সবাইকে নমস্কার জানিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলে । দিনের পর রাত আসে — রাতের পর দিন ; এমনি করে কত মাস যে যায় তার ঠিক নেই । অবশেষে একদিন সে কৃষ্ণপুর রাজ্যে এসে হাজির হলো ।
রাজ্যের বাড়ীতে সেদিন খুব ধুম়্ধাম্ — লোকজনের হৈ চৈ বাদ্যিভাণ্ডে রাজ্যিটা সরগরম । এক গয়লানী দুধের ভাঁড় মাথায় করে সেই পথে যায় । রাজপুত্র তাকে জিজ্ঞেস করে খোঁজ পেলে যে সেই দেশের রাজকন্যা ময়নামতীর সেইদিন রাত্রিকালে দক্ষিণ দেশের রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে । শুনে তার মুখ শুকিয়ে গেল , কিন্তু সে ভাব্ট্টা গয়লানীকে সে জানতে দিলে না । হেসে বল্লে ,
“ তাই নাকি , তা বেশ বেশ , আমরা গরীব লোক , দু’দিন খেয়ে বাঁচ্বো । ” তারপর গয়লানীর কাছে থেকে দুধশুদ্ধু ভাঁড়টা কিনে নিয়ে একটা ঝোঁপের মধ্যে গিয়ে কাপড়চোপড় বদলিয়ে নিজে গয়লানী সেজে দুধের ভাঁড় মাথায় ক’রে রাজার বাড়ীতে দুধ বিক্রী করতে গেল । মহলে ঢুকে ভাঁড়টা একদিকে নামিয়ে রেখে সে দাসীর কাছে খবর নিয়ে যে ঘরে রাজকন্যা ছিলো — তাড়াতাড়ি সেই ঘরে এসে হাজির হ’লো । রাজকন্যাকে দেখবামাত্রই সে চিন্তে পারলে , ঠিক একেই তো সে স্বপনে দেখেছিল । রাজকন্যাকে এককোণে ডেকে নিয়ে সে নিজের পরিচয় দিলে — আরও কত সব কথা বলে । রাজকন্যাও যেন নিজের প্রাণের কথা এতদিন পরে তার কাছে বল্তে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলে । তারপর তাকে বিদায় দেবার সময় সে বল্লে “ একপ্রহর রাতে তুমি নদীর ঘাটে কাঙালী জেলের রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠা নিয়ে বসে । থেকো ; আমি তোমার কাছে যেমন ক’রে হোক্ যাবো — তারপর দু'জনে এ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাবো । ” রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠার এমন গুণ যে , যে দেশে যে মানুষ যেতে চায় , সে দেশের কথা মনে করলে আর বৈঠা বাইতে হয় না । নৌকো সেখানে আপনা আপনি যায় । রাজপুত্র মোহনলাল রাজার বাড়ী থেকে বাইরে এসে গয়লানীর পোষাক ছেড়ে নিজের পোষাক পর্লে । তারপর তার ভাবনা হলো , সে কাঙালী জেলের রূপোর নৌকো আর সোনার বৈঠা কি করে পাবে । হঠাৎ তার মনে হলো যে বাঘমামা তো তাকে বলেছিলো , বিপদে আপদে তাকে ডাক্তে । কথাটা যেই মনে পড়া , অমনি সে হাঁটু পেতে বসে চোখ বুজে এক মনে ‘ বাঘমামা ’ ‘ বাঘমামা ' বলে ডাতে লাগলো । আর দেখতে না দেখতে বন - বাদাড় ভেঙে হালুম ’ ‘ হালুম ’ করতে করতে বাঘমামা তো তার ছেলেপুলে সব নিয়ে এসে হাজির । বললে , “ ভাগ্নে , ব্যাপার কি ? কি বিপদ তোমার ? ” রাজপুত্র বললে , “ মামা , রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠা কাঙালী জেলের ঘরে আছে— সেটা আমার দরকার । ” - আর যায় কোথা – ' হালুম ’ ‘ হালুম ' করতে করতে বাঘ তো সদলবলে গিয়ে পড়লো জেলের বাড়ী । আচম্ম্কা এমন বিপদ দেখে তারা ভয়ে তড়াসে
কেঁপেই অস্থির । বাঘ বলে , “ তোমার রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠা শীগির বের করে দাও , নইলে সবাইকে আমরা খেয়ে ফেলবো । ” তারা আর কি করে , জিনিসের চেয়ে প্রাণের মায়াই ঢের বেশি । ভয়ে ভয়ে রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠাটা বের করে দিলে । বাঘ সেটা নিয়ে রাজপুত্রকে দিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেল ।
নিঝুম রাত । জ্যোৎস্নায় যেন ফুঁইফুল ঝরছে । নদীর ডাক তার সাথে মিশে চারদিক মাতিয়ে তুলেছে । নৌকার ওপরে বসে রাজপুত্রের আর সময় কাটতে চায় না । এক প্রহর গেল , দুই প্রহর যায় — তবু রাজকুমারী এলো না দেখে তার মনটা যেন কেমন কেমন করতে লাগলো । ভাব্লে , কি বা বিপদ হয়েছে নৌকাটা বেশ করে বেঁধে রেখে ময়নামতীর খোঁজ নিতে সে রাজবাড়ীতে চলে গেল । এদিকে সেই কাঙালী জেলের মনে সুখ নেই । তার অত সাধের অমন রূপোর নৌকাখানা আর সোনার বৈঠাটা হাতছাড়া হয়েছে , সে কি আর্ স্থির থাকতে পারে ! যে ঘাটে ঐ নৌকাটা বাঁধা ছিলো— সে তারই কিছু দূরে ঝোপের মধ্যে ঢুকে মনে মনে ফন্দি আঁটতে বসেছিলো । রাজপুত্রকে নৌকো থেকে নেমে যেতে দেখে সে ভাবলে , — এইতো সুযোগ । সে দুই লাফে এসে নৌকোয় উঠে বসে তার বাঁধন যেই খুলে দিতে যাচ্ছে , ঠিক সেই সময়ে রাজকুমারী ময়নামতী এসে তাড়াতাড়ি নৌকোয় উঠে বস্লে । এদিকে নৌকো স্রোতের মুখে আল্গা পেয়ে তর্ করে ছুটে যেতে লাগলো । ময়নামতী কাঙালী জেলেকে তাড়াতাড়িতে লক্ষ্য করেনি ! তারপর ধীরে সুস্থে তার কাছে গিয়ে তার মুখের দিকে চেয়েই চমকে উঠলো । হায়রে কপাল !! কিন্তু তা হবে না ভাব্লে , আজ রাত ভোর হলেই সে বিষ খেয়ে নিজের প্রাণ নিজে দেবে , তবু একজন জেলের ঘরের বউ হতে সে কিছুতেই পারবে না । ঠিক এমনি সময়ে দৈত্যদেশের সিপাই শান্ত্রীরা ময়নামতীকে খুঁজতে খুঁজতে জেলের ঘরে এসে হাজির । তারা অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছিলো যে এইখানেই ময়নামতীকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ।
তারা দরজায় গিয়ে হাঁক দিলে , “ হেঁইও জেলে , কৃষ্ণপুরের রাজকন্যা তোমার ঘরে আছে ? ” জেলে রেগে খুন । চটেমটে বাইরে এসে তাদের সবাইকে লাঠি নিয়ে তাড়া করলে । আর যায় কোথা ! সিপাইশাস্ত্রীরা তার লাঠিটা কেড়ে নিয়ে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে আচ্ছা ঘা কতক দিয়ে দিলে । তারা তারপর রাজকন্যা , রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠা আর কাঙালী জেলেকে নিয়ে দৈত্যপুরীতে ফিরে এল । ময়নামতীকে ফিরে পেয়ে রাজপুত্র মোহনলাল আনন্দে প্রায় বেঁহুস হয়ে পড়লো । রাজকুমারীর অবস্থাও অনেকটা সেই রকম । কাঙালী জেলেকে তার বেয়াদপী আর অপরাধের জন্যে চিরজীবন কারাগারে আটক রাখা হলো ।
কিছুদিন যায় । তারপর একদিন দৈত্যপুরীর সবাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজকুমার আর রাজকুমারী রূপোর নৌকায় উঠে নিজের দেশে ফিরে চলো । - ঝম্ ঝম্ ঝম্ রূপোর নৌকা সাত সমুদ্দুর আর তেরো নদীর পথে ছুটে চলেছে রাজপুত্র মোহনলাল আর রাজকন্যা ময়নামতীকে নিয়ে । মাত্র আধেক পথ গিয়েচে কি যায় নি এমনি সময় আওয়াজ উঠলো— রূপোর নৌকা আর সোনার বৈঠা নিয়ে কে পালায়— নৌকা বাঁধো — থামাও নৌকা – নইলে .
নইলে কি – কি কথা আর শেষ হতে পেলো না । এদিকে ব্যাপার হয়েচে কি— কাঙালী জেলেকে দৈত্য রাজার লোকেরা ধরে নিয়ে যাবার পর থেকেই তার লোকজনেরা তাকে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে উদ্ধার করে আনবার জন্যে । কারণ কাঙালী ছিল জেলেদের দলের সর্দ্দার । কিন্তু খোঁজ পায় নি । এবার নদীতে রূপোর নৌকো দেখে তারা ভাবলে – বোধহয় দৈত্য রাজার লোকেরা এই নৌকোতেই কাঙালী জেলেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে । তাই হাঁক দিলে নৌকো থামাবার জন্যে ।
হাঁক শুনে রাজপুত্র ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন । এসে দেখেন নদীর
পারে বহু লোকের জনতা । এর মধ্যে কয়েকজন একটা নৌকোতে উঠতে যাচ্ছে । উদ্দেশ্য তারা নৌকোতে করে এসে তাদের নৌকোকে আটকারে । রাজপুত্র দেখলে রিপদ— সে তখনই স্মরণ করলে — বাঘমামাকে । আর যায় কোথা ! অমনি বাঘমামা সদলবলে এসে নদীর পারে হাজির ! বাঘের দল দেখে সবাই ছুটাছুটি করে পালাতে লাগলো আর যারা নৌকোতে উতে যাচ্ছিল তারা ভয়ে নদীর মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ডুবে গেলো । এদিকে রাজপুত্র সেই রাজ্য ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যে চলে এসেছে । এখন বেশ শান্তিতে তারা পথ চলতে চলতে দেশে এসে পৌঁছলেন । রাজপুত্র মোহনলালকে হারিয়ে বুড়ো রাজা আর রাণী মনের দুঃখে দিন কাটাচ্ছিলেন । এতদিন পরে তাকে ফিরে পেয়ে তাঁদের আর খুশি ধরে না । তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে তাকে আর ময়নামতীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন । তারপর – রাজপুত্রের সাথে ময়নামতীর বিয়ে । সাতদিন সাতরাত্তির আমোদ আহ্লাদ , মিঠাইমণ্ডার ছড়াছড়ি — লুচির পাহাড় — ক্ষীরের দীঘি — দধির পুকুর — নাচ - গানের বাদ্যিভাণ্ডের তুফান । বাঘমামা আর বাঘমামী , আর তাদের ছেলেপুলেরা এসে তাজা ছাগল ভেড়া খেয়ে ভাগ্নে আর ভাগ্নেবউকে আশীর্ব্বাদ ক'রে বনে ফিরে গেলো । রাজপুত্র মোহনলাল তখন রাজা হয়ে ময়নামতীকে নিয়ে মনের সুখে রাজত্ব করতে লাগলেন ।
0 মন্তব্যসমূহ