রাজারাণী গল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(ঠাকুরমার ঝুলি)

         

                     রাজারাণী 

                      --রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



এক যে রাজা , তাঁর ছিল না রাণী । রাজকন্যার সন্ধানে দূত গেল অঙ্গ , বঙ্গ , কলিঙ্গ , কৌশল , কাঞ্চী । 

তারা এসে খবর দেয় যে মহারাজ , সে কি দেখলুম ? কারু চোখের জলে মুক্তো ঝরে , কারু হাসিতে খসে পড়ে মাণিক । কারু দেহ চাঁদের আলোয় গড়া - সে যেন পূর্ণিমা রাত্রের স্বপ্ন । রাজা শুনেই বুঝলেন কথাগুলি বাড়িয়ে বলা । রাজার ভাগ্যে সত্য কথা জোটে না অনুচরদের মুখ থেকে । 

রাজা বললেন – “ আমি নিজে যাবো দেখতে । ” 

সেনাপতি বললেন , “ তবে ফৌজ ডাকি ? ”

 রাজা বললেন , “ লড়াই করতে যাচ্ছিনে । ” 

মন্ত্রী বললে , “ তবে পাত্রমিত্রদের খবর দিই ? ” 

রাজা বললেন , “ পাত্রমিত্রদের পছন্দ নিয়ে কন্যা দেখাঁর কাজ চলে না । ” “ তা হ’লৈ রাজহস্তী তৈরী করতে বলে দিই ? ” রাজা বললেন , “ আমার একজোড়া পা আছে । ”

 “ সঙ্গে কয়জন যাবে পেয়াদা ? ”

 রাজা বললেন , “ যাবে আমার ছায়াটা । ” 

“ আচ্ছা , তা হলে রাজবেশ পরুন , চুনি পান্না - হার , মাণিক - লাগানো মুকুট , হীরে লাগানো কাঁকন , আর গজমতির কানবালা । ” 

রাজা বললেন ,- “ আমি রাজার সং সেজেই থাকি , এবার সাজবো সন্ন্যাসী” ।



 রাজা সন্ন্যাসী বেশে হাতে কমুণ্ডল আর বেল কাঠের দণ্ড নিয়ে

 “ বোম্‌ মহাদেব ” বলে বেরিয়ে পড়লেন পথে । বোম দেশে দেশে রটে গেল বাবা পিনাকীশ্বর নেমে এসেছেন হিমালয়ের গুহা থেকে , তাঁর একশো পঁচিশ বছরের তপস্যা শেষ হ'ল । তিনি প্রথম গেলেন অঙ্গদেশে । রাজকন্যা খবর পেয়ে বললেন- " ডাকো আমার কাছে । ” কন্যার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামল , চুলের রং যেন ফিঙ্গের পালক , চোখ দুটিতে হরিণের চমকে ওঠার চাহনি । তিনি বসে বসে সাজ করছেন । 

কোনো বাঁদী নিয়ে এলো স্বর্ণ চন্দন বাটা , তাতে মুখের রং হবে যেন চাপা ফুলের মতো । কেউ বা আনলো মাকড়সা - জাল শাড়ী । কেউ বা আনলো হাওয়া হালকা ওড়না । এই করতে করতে দিনের তিনটি প্রহর কেটে যায় । কিছুতেই মনের মতন হয় না । 

সন্ন্যাসীকে বললেন , বাবা আমাকে এমন চোখ - ভোলানো সাজের সন্ধান বলে দাও যাতে রাজ- রাজেশ্বরের লেগে যায় ধাঁ ধাঁ , কাজকর্ম যায় ঘুচে , কেবল আমার দিকে তাকিয়ে দিন রাত্রি কাটে । ” 

সন্ন্যাসী বললেন , — “ আর কিছু - ই চাই না ? ” রাজকন্যা বললেন , “ না । ” সন্ন্যাসী বললেন- “ আচ্ছা আমি তবে চললাম , সন্ধান মিললে না হয় আবার দেখা দেব । ” রাজা সেখান থেকে গেলেন বঙ্গদেশে । রাজকন্যা শুনলেন সন্ন্যাসীর নাম ডাক ! প্রণাম করে বললেন , 

“ বাবা আমাকে এমন কষ্ট দাও , যাতে আমার দুঃখের কথায় রাজ - রাজেশ্বরের কান তাঁর কানে না যায় । ” ভরে যায় , মাথা যায় ঘুরে , মন হয় উতলা ! আমার ছাড়া আর কারও কথা যেন সন্ন্যাসী বললেন , “ সেই মন্ত্র আমি সন্ধ ান করতে বেরুলাম । যদি পাই তবে ফিরে এসে দেখা হবে । ” এর পর তিনি গেলেন কলিঙ্গে । সেখানে আর এক হাওয়া অন্ধরমহলে । 


রাজকন্যা মন্ত্রণা করছেন কি করে কাঞ্চী জয় করে তাঁর সেনাপতি সেখানকার মহিষীর মাথা হেঁট করে দিতে পারে । আর কোশলের গুমরও তাঁর সহ্য হয় না । তাঁর রাজলক্ষ্মীকে বাঁদী করে পায়ে তেল দিতে লাগিয়ে দেবেন । সন্ন্যাসীর খবর পেয়ে ডেকে পাঠালেন । বললেন , বাবা শুনেছি সহস্ৰঘ্নী আছে শ্বেতদ্বীপে যার তেজে নগর , গ্রাম , সমস্ত পুড়ে ছাই হয়ে যায় । আমি যাকে বিয়ে করবো , আমি চাই তার পায়ের কাছে বড় বড় রাজবন্দীরা হাত জোড় করে থাকবে , আর রাজার মেয়েরা বন্দিনী হয়ে কেউ বা চামর দোলাবে , কেউ বা ছত্র ধরে থাকবে । 

সন্ন্যাসী বললেন , – “ আর কিছুই চাই না তোমার ? ” রাজকন্যা বললেন , “ আর কিছুই না । ” সন্ন্যাসী বললেন , – “ সেই দেশ জ্বালানো অস্ত্রের সন্ধানে চললাম । ” সন্ন্যাসী চলে গেলেন , বললেন , - “ ধিক । ” চলতে চলতে এসে পড়লেন এক বনে । খুলে ফেললেন জটাজুট । ঝরণার জলে স্নান করে , গায়ের ছাই ফেললেন ধুয়ে । তখন বেলা প্রায় তিন প্রহর । প্রখর রোদ শরীর ক্লান্ত , ক্ষুধা প্রবল । আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে নদীর ধারে দেখলেন একটি পাতার ছাউনি । সেখানে একটি ছোট চুলা বানিয়ে একটি মেয়ে শাকপাতা চড়িয়ে দিয়েছে রাধবার জন্য । সে ছাগল চরায় বনে ; সে মধু জড়ো করে , রাজবাড়ীতে যোগান দিতে । বেলা কেটে গেছে এই কাজে । এখন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে শুরু করছে রান্না । তার পরনের কাপড় খানি দাগপড়া , তার দুটি হাতে দু শাঁখা , কানে লাগিয়ে রেখেছে একটা ধানের শিষ । চোখ দুটি তার ভোমরার মত কালো । স্নান করে সে ভিজে চুল পিঠে মেলে দিয়েছে ঠিক যেন বাদল শেষের রাত্তির । 

রাজা বললেন - “ বড়ো খিদে পেয়েছে । ” 

মেয়েটি বললে , – একটু সবুর করুন । আমি অন্ন চড়িয়েছি এখন তৈরী হবে আপনার জন্য । ” 

রাজা বললে , “ আর তুমি কী খাবে তা হলে ? 

সে বলল , “ আমি বনের মেয়ে ,

 জানি কোথায় ফলমূল কুড়িয়ে পাওয়া যায় সেই আমার হবে ঢের । অতিথিকে অন্ন দিলে পুণ্যি হয় , গরীবের ভাগ্যে তা সহজে জোটে না । ”

রাজা বললে , “ তোমার আর কে আছে ? ” 

মেয়েটি বললে , “ আছে আমার বুড়ো বাপ , বনের বাইরে তাঁর কুঁড়েঘর আমি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই । ” কাজ শেষ করে কিছু খাবার নিয়ে যাই তাঁর কাছে আমার জন্য তিনি পথ চেয়ে আছেন । ” 

রাজা বললেন , “ তুমি অন্ন নিয়ে চলো , আর আমাকে দেখিয়ে দাও সেই সব ফলমূল যা তুমি নিজে জড়ো করে খাও । ” 

কন্যা বললে , – “ আমার যে অপরাধ হবে । ” রাজা বললেন , “ তুমি দেবতার আশীর্বাদ পাবে । তোমার কোন ভয় নেই , আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো । বাপের জন্য তৈরী অন্নের থালি সে মাথায় নিয়ে চললো । ফলমূল সংগ্রহ করে দুজনে তাই খেয়ে নিলে ! রাজা গিয়ে দেখলে বাপ কুঁড়ে ঘরের দরজায় বসে । সে বললে , “ মা , আজ দেরী হলো কেন ? ” 

কন্যা বললে , “ বাবা অতিথি এনেছি তোমার ঘরে । ” বৃদ্ধ ব্যস্ত হয়ে বললে , — “ আমার গরীবের ঘর , কি দিয়ে আমি অতিথি সেবা করবো । ” রাজা বললেন , “ আমি তো আর কিছুই চাইনে , পেয়েছি কন্যার হাতের সেবা । আমি আজ বিদায় নিলাম । আর একদিন আসবো । ” তারপর সাতদিন সাতরাত্রি চলে গেল । এবার রাজা এলেন রাজবেশে । তাঁর অশ্ব - রথ সমস্ত রইলো বনের বাইরে । বৃদ্ধের পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রণাম করলেন , বললেন , — আমি বিজয়পত্তনের রাজা । রাণী খুঁজতে বেরিয়েছিলাম দেশ - বিদেশে । এতদিন ' পরে পেয়েছি - যদি তুমি আমায় দান করো , আর যদি কন্যা থাকেন রাজী । বৃদ্ধের চোখ জলে ভরে গেল । এল রাজহস্তী -কাঠকুড়ানী মেয়েকে পাশে নিয়ে রাজা ফিরে গেলেন রাজধানীতে । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ