ঠাকুরমার ঝুলির গল্প
নীল পরীদের দেশে
রাজার ফুলবাগান - গাছ আলো করে থাকে রঙবেরঙের ফুলে , বাগানের চারিধারের তারের বেড়ার আড়ালে অনেকদূর থেকেও দেখা যায় ফুলের রং , ফুলের রূপ ।
নানা গাছের সবুজ পাতার আড়ালে ফুলেরা থাকে কুঁড়ির ঢাকনির আড়ালে , সবুজ ঘোমটা তুলে একটু করে উঁকি দেয় ; বাতাস এসে তাদেরই যায় দুলিয়ে , অনুনয় বিনয় করে— “ ঘোমটা খোল ফুলরাণি সবুজ ঘোমটা খোল । ”
যেমন তাদের রূপ , তেমনি তাদের গন্ধ । সেই রূপ ও গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে কত দূর হতে ছুটে আসে কত নাম না জানা পাখি ; তারা গান গায় হাজার রকম সুরে ; ছুটে আসে প্রজাপতিরা - ফুলে ফুলে বেড়িয়ে বেড়ায় । দুনিয়ার যত ভালো আর আশ্চর্য্য ফুল আছে , রাজা সব গাছ এনে লাগিয়েছেন তাঁর বাগানে । বাগানে ফুল ফুটানোর সখ তাঁর ষোল আনা , দেশ - দেশান্তর হতে লোক আসে রাজার ফুলবাগান দেখতে । রাজা রাজকার্য করেন , প্রাণমন পড়ে থাকে ফুলবাগানের দিকে । কোন ফুলটা সবুজের আড়াল হতে কেবলমাত্র উঁকি দিচ্ছে , কোন ফুলটা সহস্রদল মেলেছে , কোন , ফুলটার পাপড়ি খসতে সুরু হয়েছে সব , যে কোন দিন তিনি বলে দিতে পারেন । রাজা দোতলায় খোলা জানলার কাছে শুয়ে ফুলের বাগান দেখেন , ফুলের গন্ধে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন । এক ঝাঁক পাখী রাজার ফুলবাগানে এসে ভারী উপদ্রপ সুরু করেছে । মালিরা তাদের দৌরাত্ম্যে অস্থির । এত ছোট পাখী , লম্বায় এক আঙ্গুলের
বড় নয় । লাল টুকটুকে তা’দের দু'খানা পাখা , ঠোঁট আর চোখ , গা - টি নরম ও সবুজ । তাদের ফুলচুরির প্রধান সহায় হল তাদের গায়ের রঙ । মালিরা ঠিক করতে পারে না — কোনটা ফুল কোনটা পাখী , কোনটা পাতা ; রঙে রঙে মিলে সব হয়ে যায় একাকার । মালিরা তীর - ধনুক ঠিক করে , ভয়ে তীর ছুঁড়তে পারে না - পাছে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে গিয়ে খসে পড়ে । পাখীর দল প্রজাপতির মত ফুলে ফুলে বসে , ছোট ছোট লাল টুকটুকে ঠোঁট দিয়ে পাপড়িগুলো উল্টোয় পাল্টায় , ছিঁড়ে কুচি কুচি করে মাটিতে ফেলে দেয় । এতে তারা কি আমোদ পায় তারাই জানে । রাজা জানলা হতে ফোটা ফুল দেখতে পান না— এ কি ব্যাপার , এর মানে ? প্রধান মালির তলব পড়ে প্রধান মালি ভয়ে ভয়ে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ায় । রাজা বজ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন , “ ফুল আর গাছে ফোটে না কেন , গাছের আর যত্ন করা হয় না বুঝি ? ” প্রধান মালি কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগল , “ মহারাজ , কতকগুলো পাখী— রাজা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন , “ পাখী - কতকগুলো পাখী , তুমি কি বলতে চাও পাখীরা ফুল ফুট্তে দেয় না ? ” হাত জোড় করে প্রধান মালি বললে , “ হুজুর তাই , আপনি নিজে যদি একদিন স্বচক্ষে দেখেন । ” রাজা বললেন , “ আজই যাব । ” রাজকার্য্যের ভার রইল মন্ত্রীর ওপর , রাজা গেলেন বাগানে । এইবারই বাধলো মজা । রাজার মাথায় মুকুট ঝিল্মিল্ করছে , পোষাক ঝিল্মিল করছে , তাই দেখে ছোট পাখীগুলো দলশুদ্ধ পড়লো রাজার ওপর ঝাঁপিয়ে । কেউ ঠুকরায় মুকুট , কেউ পোষাক , কেউ তলোয়ার । রাজার অবস্থা তখন যা ’ হলো- সে আর বলবার নয় । রাজা দুইহাতে শূন্যে তুলে লাফান , পাখীদের মারতে যান ,
কিন্তু তাঁর কিল , ঘুসি একটা পাখীর গায়েও লাগে না । তাঁর চীৎকারে একশো মালি ছুটে আসে , সিপাই - শাস্ত্রী ছুটে আসে ।
কিন্তু এলেই বা কি ? তারা সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকে একটা পাখীকেও মারতে পারে না - পাছে রাজার গায়ে লাগে । রাজা চেঁচান- “ রক্ষা কর - রক্ষা কর - রক্ষা কর । ” কিন্তু কে তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে মেরে ফেলবে ? অবশেষে হতভম্ব প্রধান মালি দৌড়াল মন্ত্রীর কাছে যদি তিনি কোন মন্ত্রণা দেন । মন্ত্রী ছুটে এলেন । লক্ষ্য করে বুঝলেন - পাখীদের লোভ আসলে রাজার উপর নয় , ঝিল্মিল জিনিসগুলোর উপর । বুদ্ধি করে তখনই তিনি রাজার মুকুট , পোষাক আর তলোয়ার নিয়ে ফেলে দিলেন । রাজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন , কপালের ঘাম মুছে সরে দাঁড়ালেন । . মন্ত্রী বিবেচনা করে বললেন , “ এ পাখীদের মারা যাবে না , খুব জোরে কোন আওয়াজ কর , তাতে পাখীরা ভয় পেয়ে যদি পালায় । ” মন্ত্রীর বুদ্ধিতে পাখীর ঝাঁককে তাড়ান গেল । কিন্তু একটা পাখী পালাতে গিয়ে বেড়ায় গেল আটকে - রাজা নিজের হাতেই তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে মেরে ফেলেন । সেই দিন গভীর রাত্রে একটা বিকট শব্দে রাজার ঘুম ভেঙ্গে গেল ; মনে হল - বাগানের উপর দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাসের ঝড় বয়ে গেল । সকালবেলাই প্রধান মালির চীৎকার- “ মহারাজ , মহারাজ , সর্বনাশ ' ধড়ফড় করে উঠে রাজা জিজ্ঞাসা করেন , “ কি ? ” হয়েছে । ” মালি কেঁদে ফেলে বললেন , “ ফুলগাছ শুয়ে পড়েছে হুজুর , পাতা সব নুইয়ে পড়েছে । ” রাজা দুইচোখ কপালে তুলে বাগানে ছুটে যান । একটিমাত্র ফুলগাছে একটিমাত্র ফুল ফুটে রয়েছে ঠিক বেড়ার ধারে —আর মাইলের পর মাইলব্যাপী গাছ মাটিতে শুয়ে ; মনে হচ্ছে , কাল রাত্রে ভীষণ ঝড়ের দমকা হাওয়া বয়ে গেছে এদের উপর দিয়ে । কত লক্ষ লক্ষ টাকা - আর কত যত্ন , ভালবাসা রাজা যেন পাগল হয়ে উঠলেন । এরকম কেন হল ; কোন দেবতার
শাপে তাঁর এত বড় বাগানের এ অবস্থা হল ? মন্ত্রী এলেন , সভাসদবৃন্দ সবাই এলো শহর হতে আনা হল বড় বড় জ্যোতিষী , তারা কেউ গুণে যদি ঠিক করে বলতে পারে তার গাছগুলোকে আবার তাজা করার উপায় বলে দেয় , তাদের উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে । প্রধান জ্যোতিষী খড়ি দিয়ে অনেক আঁক কষে শেষে গম্ভীর মুখে বললেন , “ সর্বনাশ হয়েছে মহারাজ , আপনার বাগান পরীর দৃষ্টিতে পড়েছে । পাখী হয়ে যারা উপদ্রব করতো তারা সব পরী । একদিন এখান দিয়ে চলে যেতে ফুলের রূপে আকৃষ্ট হয়ে তারা পাখীর রূপ নিয়ে এখানে আটকে পড়েছিল । আপনি তাদের মেরে ফেলেছেন , পরীর দীর্ঘশ্বাসে তাই , আপনার ফুলবাগান শুকিয়ে উঠেছে । ” পরী ? রাজা মাথায় হাত দিয়ে বসেন- “ এখন উপায় ? কি করলে পরীর দৃষ্টি এড়ানো যাবে ? ” জ্যোতিষী বললেন , “ ওই যে একটিমাত্র গাছে একটিমাত্র ফুল ফুটে আছে , ওইটি নিয়ে যেতে হবে সেই সাতসমুদ্রের ওপারে নীলদ্বীপে , সেইখানে থাকে নীলপরীদের রাণী । তাকে যদি কোন রকমে খুশী করতে পারেন , আপনার বাগান আবার তাজা হয়ে উঠবে । ” রাজা জ্যোতিষীকে বকশিস দিয়ে বিদায় করে তখনই সাতসমুদ্রের ওপারে নীলদ্বীপে যাওয়ার উদ্যোগ করেন । রাণী আছড়ে পড়ে কাঁদেন- “ যেয়ো না , ” ছেলে হাত ধরে কাঁদে- “ যেয়ো না ” কিন্তু রাজার ফুলবাগান একদিকে , আর সব একদিকে । রাজার ময়ূরপঙ্খী নৌকা তৈরী হল , রাজা তেত্রিশকোটি দেবতাকে প্রণাম করে সেই একটি গাছের একটি ফুল তুলে নিয়ে ময়ূরপঙ্খীতে উঠলেন । ঠিক সেই সময় মাথার উপর দিয়ে ঝড়ের মত একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল । তীক্ষ্ণসুরে কে যেন বলে গেল- “ সাবধান - সাবধান - সাবধান । ” রাজা চমকে ওঠেন -মন্ত্রী চারিদিকে চান , কে একথা বললে ? সবাই তাকায় পরস্পরের দিকে - কেউ তো একথা বলে নি । রাজার ময়ূরপঙ্খী অথই জলে সাগর বুকে ভাসলো । রাণী সাতমহল
বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেন , নৌকো ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে , রাজপুত্র মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে , ময়ূরপঙ্খীর রঙিন হাল নীল আকাশের বুকে মিলিয়ে গেল । মা ছেলে দু'জনে আছড়ে - পিছড়ে করে কাঁদেন । দিনের পর দিন যায় , বৎসরের পর বৎসর যায় রাজা আর রাজ্যে ফিরলেন না । রাজ্যময় বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হলো - চুরি , ডাকাতি লুঠচললো । রাজার বড় সাধের ফুলবাগানের বেড়া ভাঙ্গতে শুরু করলে , কিন্তু আশ্চর্য্য বৎসরের পর বৎসর ধরে গাছগুলো একইভাবে পড়ে রইলো - একটি পাতাও তাদের শুকলো না । বাগানের এক কোণে একটি গাছে একটি করে ফুল প্রত্যহ ফুটতে লাগলো , কোন দিনই ফোটা বন্ধ হ’লো না । রাজপুত্র অরুণকুমার মায়ের কাছে অনুমতি চায়- “ তুমি আদেশ দাও মা , আমি বাবাকে আনতে যাই । পরীরা হয়তো বাবাকে বন্দী করে রেখেছে , চাকরের মত খাটাচ্ছে , আমি বাবাকে নিয়ে আসি । ” রাণী কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নেন , “ তুই কি পারবি অরুণ , তুই যে বড় ছেলেমানুষ । ” অরুন হাসে - বলে , “ আমি মস্ত বড় হয়েছি তবুও তুমি আমায় ছেলেমানুষ বল । তের বছর বয়স আমার তুমি আমায় ছেলেমানুষ বলো না । এক বছর তুমি অপেক্ষা করো এক বছরের মধ্যে আমি বাবাকে নিয়ে ময়ূরপঙ্খী নৌকো নিয়ে ফিরে আসবো দেখো । ” রাণী আর কি করেন । ছেলের জিদে তাকে বিদায় দিতেই হল । রাজপুত্র বাগানের সেই একটি মাত্র ফুল তুলে নিলে । জ্যোতিষীর কাছে সে শুনেছিল - একটি মাত্র গাছ যে পরীর দৃষ্টি এড়াতে পারে । এই একটি মাত্র ফুল যার কাছে যতক্ষণ থাকবে , পরী ততক্ষণ তার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না । এই ফুল হারানোর সঙ্গে সঙ্গে সে আগেকার সব কথা ভুলে যাবে এবং পরীর মায়ায় পড়তে হবে । রাজপুত্র অরুণকুমার একটা ছোট্ট নৌকায় উঠলো , চারজন মাত্র দাঁড়ি মাঝি তাতে ।
রাণী কাঁদতে কাঁদতে আশীর্ব্বাদ করে ছেলেকে বিদায় দিলেন । রাজপুত্র অরুণকুমারের নৌকো ভেসে চললো সাতসাগরের ওপারে নীলদ্বীপের উদ্দেশ্যে যেখানে নীলপরীর কাছে তার বাপ বন্দী হয়ে রয়েছে । নৌকোর ঠিক সামনে আকাশের কোল বেয়ে চলছিল একটা পাখী সেই পাখীটাই যে অরুণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছিল । বুড়ো মাঝি বলছিল , “ এরকম পাখী মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায় , এরা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে । ” দিনের পর দিন যায় , জলের আর শেষ নাই , কোথায় সাতসাগরের পারে সেই নীলদ্বীপ - চিহ্নও দেখা যায় না । জ্যোতিষীর কথার পরে অরুণের অগাধ বিশ্বাস । বুড়ো মাঝি মাঝে মাঝে আবল তাবল বকে , বলে - ‘ জ্যোতিষী মিছে কথা বলেছে । ' কিন্তু কুমার তা বিশ্বাস করে না । ফুলটাকে সে সব সময়ে নিজের কাছে রাখে । আশ্চর্য্য - দিনের পর দিন , মাসের পর মাস যায় , ফুলটা যেমন তাজা তেমন তাজা রয়েছে , একটা পাপড়ি শুকায় নি , রঙ পর্য্যন্ত খারাপ হয় নি । অনেকদিন পরে দাঁড়ি - মাঝিরা চীৎকার করে উঠলো , “ একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে । ” ওই - ই তাহলে নীলদ্বীপ । কুমারের আর আনন্দ দেখে কে ? রাত্রে আকাশ ছেয়ে গেল ঘন কালো মেঘে , সোঁ সোঁ করে ঝড় এলো । অরুণ বুঝতে পেরেছে এ সব পরীর মায়া , সে ফুলটিকে জামার পকেটে রেখে ঘৃতা দিয়ে পকেটটাকে এমন করে সেলাই করলে যাতে কিছুতেই সে ফুল পড়ে যাবে না । সোঁ সোঁ করে একটা ভীষণ দমকা ঝড় এসে ছোট্ট নৌকাখানাকে শুদ্ধ দ্বীপের উপর আছড়ে ফেললে । পড়বার সেই ভীষণ আঘাতে অরুণ মূর্ছিত হয়ে পড়ল ; মাঝি - মাল্লারা নৌকো হতে কে কোন্দিকে ছিট্কে পড়ল , কেই বা তার হিসাব রাখে , কেই বা তা ’ দেখে ? পূবের লাল আলো ধরার গায়ে পরশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরুণের মুচ্ছার ভাব কেটে গেল , সে ধরফড় করে উঠে বসলো । তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে দেখলে না , ফুলটা ঠিক আছে । তবে সে পরীর মায়ায় কিছুতেই পড়বে না , তাই পিতাকে সে নিশ্চয়ই মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারবে । মাথার উপর দিয়ে কে যেন বিদ্রুপের হাসি হেসে গেল - হা - হা - হা অরুণের গা ’ কাঁটা দিয়ে উঠলো , সে মুখ তুলে চাইলে , কোথাও কিছু দেখতে পেলে না । অরুণ সামনের দিকে এগিয়ে চললো । কি সুন্দর পথ , যেন মোমে তৈরী - দু’ধারে কত ফুলগাছ , কত ফুল ফুটেছে । এক জায়গায় তার বয়সী অনেকগুলো ছেলেমেয়ে খেলছে । অরুণকে দেখে তারা কাছে দৌড়ে এলো- “ কে ভাই তুমি , কোন দেশের রাজপুত্তুর ? এসো না , আমাদের সঙ্গে কাণামাছি খেল্বে ? ” কাণামাছি হওয়ার ফাঁকে ফুলটি যাবে । অরুণ মাথা নাড়লে , গম্ভীরভাবে এগিয়ে চললো । খানিক দূর যেতেই পেছনে হো হো , হা হা হাসির শব্দ পেছন ফিরে দেখে সব মিলিয়ে গেছে । পথে দেখা গেল , কত হিংস্র জন্তু তারা হাঁ করে খেতে চায় , কিন্তু কাছে আসতে পারে না । চট করে সামনে একখানি লম্বা মাটি চিরে বার হয়ে পড়লো স্রোতবতী এক নদী । অরুণ ভয় না পেয়ে নদীর জলে দিলে পা তখনি সে নদী গেল শুকিয়ে । সামনে জেগে উঠলো মস্ত বড় পাহাড় , তখনি গেল মিলিয়ে । যেতে যেতে সামনে জাগলো মস্ত বড় গর্ত্ত - পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভ মিশে গেল । এ সবের জন্যে অরুণ প্রস্তুত হয়ে এসেছিল । তার কাছে যতক্ষণ ফুল থাকবে ততক্ষণ কেউই তাঁর এতটুকু অনিষ্ট করতে পারবে না , তার মাথার চুল নড়াতে পারবে না - তা ’ সে জানে । সে পকেটের উপর হাতখানা রেখে সোজা হন হন করে চললো । কোথায় বাজে বাঁশী - কি মিষ্ট সে বাঁশীর সুর - মূহুর্ত্তের জন্য অরুণ যেন অভিভূত হয়ে পড়লো , এমন বাঁশীর সুর সে খুব কম শুনেছে । সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো , মা বলেছেন , পরীরা মায়া জানে , তারা মায়া করে মানুষকে ভেড়া গরু পাখী যা ’ খুশী করতে পারে । অরুণ দেখতে পেলে একটি ফুলের বাগানে লক্ষ লক্ষ ফুল ফুটেছে , সেখানে কোমল দুব্বার উপর কত সুন্দরী মেয়ে- কেউ গান গাইছে , কেউ নাচছে , কেউ বাঁশী বাজাচ্ছে । মাঝখানে রত্নাসনে বসে আছে পরমা সুন্দরী একটা মেয়ে । অরুণকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল ।- “ এসো , এসো কুমার , আমরা তোমার জন্যে বসে আছি । এই নাও – সিংহাসন নাও , মকুট নাও , মালা নাও ; সব নাও তুমি এখানকার রাজা হয়ে বাস কর । ” অরুণ একবার পকেটে হাতখানা রাখলে তারপর থু থু করে কতকটা থুথু তাদের দিকে ছুঁড়ে দিলে । দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব মিলিয়ে , কোথায় গেল সেই সব পরীরা , কোথায় গেল ফুলবাগান , পরীর গান - সেখানে জেগে উঠলো ধূ ধূ মরুভূমি , গাছ নাই ঘাস নাই , লতা নাই - পাতা নাই । অরুণ দেখতে পেলে দূর হতে একটি লোক আসছে - সে যেন হাঁটতে পারছে না , পা তার ভেঙ্গে পড়েছে । তার মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেছে , একমুখ সাদা - দাড়ি - গোঁফ , হাতে পায়ে বড় বড় নখ । অরুণ প্রথমটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল - তারপরই চোখের দিকে চেয়ে সে চিনতে পারলে , এই তার বাবা “ বাবা - বাবা- ” অরুণ দুই হাত তুলে তার বাবার কোলে ছুটে গেল । রাজা প্রথমটা চিনতে পারেন নি , তারপরই চিনতে পেরে ছেলেকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ঝর্ ঝর্ করে চোখের জল ফেলতে লাগলেন । মাঝি - মাল্লাদের খুঁজে অরুণ নৌকো ঠিক করে পিতাকে নিয়ে নৌকায় উঠলো । পরীর মায়ার আকাশ তখন কালো মেঘে ছেয়ে এসেছে । নীলদ্বীপে তখন ভূমিকম্প , অগ্নিবর্ষণ শুরু হয়েছে । চারিদিকে হুম - হাম , দুমদাম শব্দ কান্না হাসি , তর্জ্জন - গর্জ্জন সে সব শব্দে কানপাতা দুরূহ । রাজা বললেন , “ কিছু করতে হবে না , একশোবার দেবতার নাম করে নৌকো ছাড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে ! ” একশোবার দেবতার নাম করে নৌকো ছাড়া হল । আকাশ হয়ে গেল পরিষ্কার - শব্দ সব মিলিয়ে গেল ।
নৌকো সাগরের বুক চিরে সোঁ সোঁ করে ভেসে চললো । রাজার সব কথা শোনা গেল । রাজা আসতে গিয়ে ঝড়ের বেগে নীলদ্বীপে আছড়ে পড়েন , ফুলটা সেই সময়েই হারিয়ে যায় । পরীরা তাঁকে সিংহাসন , মুকুট দেওয়ার লোভ দেখায় রাজা সহজেই ভুলে যান । তারপর হল দুর্গতির একশেষ । রাজা ক্রমে ক্রমে সব কথা ভুলে গেলেন ; তাদের চাকর হয়ে সেখানে বাস করতে লাগলেন । এক একদিন মূহুর্তের জন্য জ্ঞান হতো , কিন্তু দেশে ফিরবার কোন উপায় পেতেন না ।
প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
0 মন্তব্যসমূহ